গী দ্য মোপাসাঁ এর গল্প- শিল্পী
বৃদ্ধ বাজিকর আমাকে বলল- ব্যাপারটা আর কিছু নয়, মঁসিয়ে, অনুশীলন আর অভ্যাস! অবশ্য কিছুটা প্রতিভা চাই। আঙুল নরম হলে চলবে না; তবে তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে অভ্যাস, আর অনেক বছর ধরে প্রত্যহ অনুশীলন।
তার এই বিনয়নম্র বচন আমাকে অবাক করে দিল; কারণ, যে-সমস্ত দাম্ভিক বাজিকরের খেলা আমি দেখেছি; আমার মতো সবাই দেখেছে- সার্কাস বা অন্যান্য খেলায় সে অংশগ্রহণ করে। তার খেলাটা হচ্ছে- একটা কাঠের গায়ে হেলান দিয়ে একটি পুরুষ অথবা মেয়ে দু-হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকে, আর সে দূর থেকে সেই মানুষটির আঙুলের ফাঁকের মধ্যে অথবা তার মাথার পাশে ছুরি ছুঁড়ে বিঁধিয়ে চলে। যদিও ছুরিগুলো ধারালো, আর দেহ থেকে অল্পকিছুটা দূরে কাঠের ওপর সেগুলো গেঁথে যায়, তবুও কৌশল জানলে কোনো খেলোয়াড়ের কাছেই এটা এমন কিছু অসামান্য দক্ষতার ব্যাপার নয়। শুধু ছুঁড়ে দেয়ার দ্রুততা আর যে অর্ধবৃত্তাকারে ছুরিটা জীবন্ত মানুষের দিকে দৌড়ে যায়- এ দুটো জিনিশই এই খেলার সময় প্রদর্শনীতে বিভীষিকার সৃষ্টি করে। তবুও সার্কাসের খুব অতি সাধারণ পর্যায়ের খেলা এটা।
কিন্তু এই খেলার মধ্যে কোনোরকম কৌশল নেই, নেই কোনো প্রতারণা, দর্শকের চোখে ধুলো দেয়ারও প্রচেষ্টা নেই কোনো। এসব কেবল খেলার জন্যে খেলা; এর মধ্যে ফাঁকি দেয়ার কোনো বাসনা নেই। এই বৃদ্ধ বাজিকরটি খুরের মতো ধারালো ছুরিটাকে একেবারে দেহের গা ঘেঁষে কাঠের ওপরে বিঁধিয়ে দেয়। এইভাবে ছুঁড়ে-ছুঁড়ে মানুষটির মাথার চারপাশে ছুরির পর ছুরি দিয়ে বৃত্ত সাজায়, গলার পাশে ছুরিগুলি গলবন্ধনীর মতো এঁটে বসে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বাজিকরটি এই দুঃসাধ্য কাজ করে নিজের চোখদুটো পুরু ‘অয়েল ক্লথ’-এ ঢেকে।
স্বাভাবিক ভাবেই অন্যসব বড় কলাবিদের মতোই তাকেও তাকেও কেউ স্বীকৃতি দেয়নি। সবাই বিশ্বাস করত ওটা নিছক কৌশল; ও-মুখোশটা ছিল তাদের কাছে আরও একটা ধাপ্পা- যে ধাপ্পাটা অতি সাধারণ।
তারা বলাবলি করত- লোকটা আমাদের বোকা মনে করে, তাই না? না-দেখে লোকটা কী করে লক্ষ্যবস্তুর দিকে অনায়াসে ছুরি ছুঁড়ে?-
তারা ভাবত ওই অয়েল-ক্লথের ভেতর খুব ছোটো-ছোটো ফুটো রয়েছে। খেলা শুরু হওয়ার আগে দর্শকদের অয়েল-ক্লথটা পরীক্ষা করতে দিয়েও কোনো কাজ হত না। কোনো ফুটোই তাদের চোখে পড়ত না; আর পড়ত না বলেই তারা বিশ্বাস করত বাজিকর তাদের নিশ্চয় ঠকাচ্ছে। এইসব খেলায় দর্শকদের যে নানাভাবে প্রতারণা করা হয়, তা তারা ভালো করেই জানে।
সেই বৃদ্ধ বাজিকরটির মধ্যে যে কলাবিদটি লুকিয়েছিল আমি তাকে চিনতে পেরেছিলাম। তার মধ্যে যে বিন্দুমাত্র প্রতারণা ছিল না-সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম। সে-কথা তাকে আমি খুলেও বলেছিলাম। তার প্রতি আমি যে সুবিচার করছি এটা বুঝতে পেরে সে অভিভূত হয়েছিল। ফলে আমাদের দুজনের মধ্যে বেশ একটা বন্ধুত্ব জন্মেছিল। জন্মেছিল বলেই দক্ষতার আসল উৎস্য কোথায় সে-কথাটা সে আমাকে বলেছিল। তার পক্ষে যে-কোনো কৌশল করা একেবারে অসম্ভব- আমার এই অভিমত শুনে সে আমাকে বলল, নিশ্চয়; এতটা অসম্ভব যে আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না; কিন্তু কাদের এ-কথা আমি বোঝাব-কে বুঝবে?
তার মুখ কালো হয়ে গেল; চোখ ভরে এল জলে। তাকে আর কোনো কথা জিজ্ঞেস করতে আমি সাহস পেলাম না। আমার চোখ-মুখের চেহারা দেখে সে নিজেই বলল, অবশ্য সে কথাটা আপনাকেই বা আমি বলব না কেন? আপনি কেন আমাকে বুঝবেন।
তারপরে স্বরটাকে হঠাৎ তীক্ষ্ণ আর বিকৃত করে সে বলল- আর কেউ বুঝুক আর না বুঝুক, সে অন্তত বোঝে।
কে?
আমার হতচ্ছাড়া বৌ। হায় মঁসিয়ে, মেয়েটা যে কী ধরনের জঘন্য তা যদি আপনি জানতেন? হ্যাঁ, সে জানে। খুব ভালোই জানে আমার কৌশলটা কোথায়। সেইজন্যেই আমি ওকে ঘেন্না করি। আমাকে প্রতারণা করার জন্যে যতটা, তার চেয়ে বেশি ঘেন্না করি করি এইজন্যে। প্রতারণা করাটা মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম এবং ক্ষমার্হ। কিন্তু দ্বিতীয় অপরাধটি সাংঘাতিক।
যে-মেয়েটি হাত প্রসারিত করে একটা কাঠের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, যার মাথার চারপাশে বাজিকর খুরের মতো ধারালো অজস্র ছুরি ছুঁড়ে-ছুঁড়ে বেঁধায়- সেই মেয়েটিই তার স্ত্রী। বয়স তার সম্ভবত চারের কোঠায়; দেখতে ভালোই; কিন্তু সৌন্দর্যে এমন কিছু আছে যা মানুষের মনে বিতৃষ্ণা জাগায়। তার মুখের আদল ঔদ্ধত্যে মাখা-মুখটা স্থুল ও জৈব-কামনায় উদ্দাম, এক কথায় কুৎসিত। আমি অনেকদিন লক্ষ করেছি বাজিকর যখন তার মাথার চারপাশে ছুরির বৃত্ত এঁকে দিত তখন মেয়েটি হাসত। হাসিটা মৃদু, কিন্তু দেখলে মনে হবে এ হাসির পেছনে একটা বিশেষ অর্থ রয়েছে; অনেকটা ব্যঙ্গের হাসির মতো। হাসিটিকে আমি পরিবেশের উপযুক্ত হাসি বলেই ধরে নিয়েছিলাম, কিন্তু বাজিকর যখন হাসির উদ্দেশ্য আমাকে বুঝিয়ে বলল তখন আমি যথেষ্ট অবাকই হয়ে গেলাম- হাসিটা তার শুনেছেন? সে আমাকে ঠাট্টা করে, আমাকে অগ্রাহ্য করে হাসে। কারণ, সে জানে তার কোনো ক্ষতি হবে না। আর আমি যাই করতে চাই না কেন, যত ক্ষতিই তার করা উচিত হোক না কেন- শেষ পর্যন্ত কোনোকিছু করাই আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।
কী তুমি করতে চাও?
যা বাবা! কিছুই আপনি বুঝতে পারছেন না? আমি তাকে খুন করতে চাই।
তাকে খুন করতে চাও- কারণ সে তোমার….?
কারণ সে আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে? না, না। মোটেই তা নয়। আমি আবার বলছি মোটেই তা নয়। সেজন্যে তাকে আমি অনেকদিন আগেই ক্ষমা করেছি। তাছাড়া, ওটা আমার অভ্যাসও হয়ে গিয়েছে। তাকে প্রথম ক্ষমা করার সময় একটা কথা তাকে বলে আমি অন্যায়ই করেছি। আমি তাকে বলেছি একদিন তাকে আমি খুন করব; এমন ভাবে করব কেউ বুঝতেও পারবে না যে আমি তাকে খুন করেছি- সবাই ভাববে নেহাৎই ওটা একটা অ্যাকসিডেন্ট।
তা্ বুঝি?
অবশ্যই। সেরকমই বাসনা ছিল আমার। তাকে যে খুন করার অধিকার আমার আছে সে কথা আপনিও স্বীকার করবেন। আর কাজটা কত সহজ, কত লোভনীয়। ভেবে দেখুন- একটু ইতরবিশেষ হলেই ব্যস! আধ ইঞ্চি এদিক-ওদিক-ছুরিটা গলা ফুটো করে কণ্ঠনালীটা এফোঁড়-ওফোঁড় করে চলে যাবে। তারপরেই সব সাফ। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটবে চারপাশে- তারপরেই সব শেষ। সে মারা যাবে; আমারও চরিতার্থ হবে প্রতিহিংসা।
নিশ্চয় নিশ্চয়, খুব সত্যি কথা- ভয়ংকর রকমের সত্যি কথা।
আর তার জন্যে আমাকে কোনোরকম ঝুঁকি নিতে হবে না। একটু দুর্ঘটনা! দুর্ভাগ্য! আমাদের পেশায় একরম দু-চারটে দুর্ঘটনা হয়ই। আমাকে তারা দায়ী করতে পারবে না। আর করবেই বা কেন? ভুল করে নরহত্যা ছাড়া অন্য কোনো অভিযোগই আমার বিরুদ্ধে টিকবে না। আমাকে বরং তারা করুণা দেখাবে। ‘আমার বৌ, আমার বৌ’ বলে আমি চিৎকার করব; বলব, ও আমার এত উপকারী বন্ধু ছিল। রুজি-রোজগারের অর্ধেকটাই নির্ভর কর ওর ওপরে। আমার খেলার সাথী। কী বলেন?
নিশ্চয়ই। এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্হে নেই।
তাছাড়া এইরকম প্রতিহিংসা যে সুন্দর প্রতিহিংষা সে-কথাও আপনি স্বীকার করবেন। আর এমন একটা প্রতিহিংসা যা আমি নিরাপদ হয়েই চরিতার্থ করতে পারি।
আমারও তো তাই মনে হচ্ছে।
হচ্ছে তো! অথচ আমার এই মনের বাসনাটা যখন আমার বৌকে বেশ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলাম তখন সে কী বলল জানেন?
বলল, তুমি একটি সৎ বালক; এমন ভয়ানক কাজ মোটেই তুমি করতে পারবে না…
থামুন থামুন। আপনি যা ভাবছেন আমি মোটেই তা নই; যদিও বিস্তারিতভাবে আপনাকে বলে কোনো লাভ নেই, তবু জেনে রাখুন- রক্ত দেখে ভয় পাওয়ার বান্দা আমি নই। তার কাছেও প্রমাণ দেখানোর প্রয়োজনীয়তা আমার ছিলো না, কারণ সে ভালোই জানত আমাকে; বিশেষ করে একটি বিষয়ে আমার দক্ষতা যে অসাধারণ সেটা জানতে তার বাকি ছিল না।
সে ভয় পায়নি?
উহুঁ। সে কেবল বলল আমি যা করব বলে শাসাচ্ছি তা করার ক্ষমতা আমার নেই। বিবেচনা করুন কথাটা। আমি করতে পারব না।
কেন পারবে না?
বুঝছেন না কেন পারছি না? আমি কি আপনাকে বলিনি কী দীর্ঘ কষ্টসাধ্য কঠোর অনুশীলন করে চোখ বুজে ছুরিগুলোকে আমি লক্ষ্যস্থলে বেঁধাবার অভ্যাস আয়ত্ত করেছি?
বলেছিলে? কিন্তু তাতে কি হয়েছে?
কী হয়েছে? আপনি কি বুঝতে পারছেন না, যে কঠোর সাধনার ফলে চোখ বেঁধে ছুরি ছোঁড়ার কৌশলটা আমি আয়ত্ত করেছি, সেই সাধনার কারণেই ভুল করার ইচ্ছে সত্ত্বেও আমি ভুল করতে পারব না?-সে কথাটা সে বুঝতে পারেনি?
এ্রও কি সম্ভব?
আমি দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি এর চেয়ে বেশি সত্যি আর কিছু নেই। ওই দুর্বিনীতা অবাধ্য মেয়েমানুষটার গলা কাটার জন্যে একটু ভুল করার জন্যে অনেক চেষ্টা আমি করেছি; কিন্তু পারিনি। ফলে, ওই বেশ্যাটা সবসময় আমাকে উপহাস করে হেসেছে।
কথা বলকে বলতে তার চোখদুটো জলে ভরে এল। সে রাগে গরগর করতে করতে দাঁতে দাঁত চেপে বলল- আপনি আমাকে যতটা দেখতে পাচ্ছেন, আমি নিজে আমাকে যতটা জানি, ওই মেয়েটা তার চেয়েও অনেক বেশি আমাকে চেনে। ও জানে আমি আর মানুষ নই, নিখুঁত এটা যন্ত্র। এ যন্ত্র কোনোদিন বিগেড়ে যাবে না। সে জানে-ভুল করতে আমি পারব না, পারব না।
আরও পড়ুন- গী দ্য মোপাসাঁ এর গল্প- প্রতিহিংসা