আক্রোশ- অনামিকা হক লিলি- গল্প

Mostafizur Rahman
Mostafizur Rahman

Mostafizur Rahman is a professional content writer at CrawlText, specializing in SEO articles, blog posts, and web copy that drive engagement and conversions. With experience crafting clear, audience-focused content for almost all the niches, he delivers well-researched, optimized pieces on deadline. He combines editorial rigor with keyword strategy to boost traffic, authority, and reader retention across blogs, platforms, and newsletters.

বড়শি ফেলে বসে আছে সবুজ। আজকে ওর কাছে বল্লার চাক ভাঙা টোপ, তুলতুলে শরীরকে এ ফোড় ও ফোঁড় করে বড়শিতে গাঁথতে মায়া লাগে সবুজের। তাজা কেঁচো টুকরো টুকরো করে নিতেও। আর যখন তাজা ব্যাঙ সারারাতের জন্য গেঁথে রেখে দেয় তখনও কি যেন মনে হয়ে ভারি হয়ে ওঠে মনটা। একজনকে মেরে একজনকে ধরার ফাঁদ, এইসব তত্ত্বকথা মনে হতে থাকে। বিশ্বপিতার এই অদ্ভুত লীলা ওকে ওর শিশুকালে নিয়ে যায়। ক’বছরের ছিলো সে? কতটুকু? কেন যে স্মৃতিতে তার ঝকঝকে হয়ে সবকিছু নেই? স্মৃতিতে তেমন কিছু নেই অথচ তারই বোঝাভার জীবনের পাতায় পাতায় লেখা। স্বাধীনতা তাকে তো এক কণা কিছু দেয়নি, শুধু তো কেড়েই নিয়েছে।

সবাই বলে দেশমায়ের চেয়ে আর কি বড় আছে? সবুজের কাছে এ সব ছেদো কথা বলে মনে হয়। যুদ্ধে যার নিজের মা হারিয়ে যায় তার কাছে আর সব অর্থহীন হয়ে যায়। যার বাবা সরকারের কাজে গিয়ে বাড়ি ফিরবার পথ পায় না সে কি খুঁজে পাবে স্বাধীনতার মধ্যে? স্বাধীনতার সে স্বাদ বিস্বাদ তার কাছে, তেতো ভীষণ তেতো।

ফাতনায় টান পড়লেও সবুজের খেয়াল আসে না ঝটকরে বড়শি তোলার, থাক, খেলুক না মাছটা। মরণ খেলা খেলুক কিছুক্ষণ। সবুজের একটু একটু নিষ্ঠুর হতে ইচ্ছে করে।

চাচা সাবের আলী এগিয়ে আসে পায়ে পায়ে, নারকেল গাছের গুড়িটা থেকে কিছুটা শরীর পুকুরের দিকে সোজা গিয়ে তারপর বেঁকে ওপরে উঠেছে। এতে দিব্যি দু’জন পাশাপাশি বসে পা দুলাতে পারে পুকুরে। ভরা বর্ষায় ঘাটের বৈঠার কাজ করে। সাবের আলী জানে এই জায়গাটা সবুজের খুব প্রিয়। সবুজ সেই ছোট থেকে এই জায়গায় এসে এসে বসে থাকতো, এমন কি চৈত্রের বিরাট দুপুরে এখানে সে মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে যেতো। আছরের নামাজ শেষে ফিরবার পথে তবে তুলে নিয়ে যেতো সাবের আলী। তারপর যখন বাইরে পড়তে গেলো তখনও ছুটি কাটায় এলে এখানে বসেই সময় কাটায়। একা একা চুপচাপ বসে কাটায় ঘন্টার পর ঘন্টা।

সবুজের জন্য মন কেমন করে ওঠে সাবের আলীর। সে এতো স্নেহ দিয়ে ভালোবাসা দিয়েও তো সবুজের কষ্ট ভুলাতে পারলো না, পারলো না ওর শূন্যস্থান পূরণ করে দিতে। সেই সময় সবুজ আরেকটু ছোট থাকলে কি এমন ক্ষতি হতো?

যুদ্ধের সময় যদি ও অবোধ শিশু থাকতো তাহলে দিব্যি মিলেমিশে যেতো। যদিও সবুজ তাদের পরিবারে মিলেমিশেই আছে, কোনদিন এতটুকু বেয়াদবী, উচ্চবাচ্য বা রা করেনি কিছু নিয়ে।

সাবের আলীর দুঃখ সেখানেই। উচ্চবাচ্য করেনি বলেই সবুজ সবসময় নিজের ব্যাপারে সচেতন থেকেছে। সবুজ যে একজন অন্যকেউ, বাড়ির কেউ নয় তা সে কোনদিনই বুঝি ভুলতে পারেনি। তবে সাবের আলী যে শ্রদ্ধা যে ভক্তি পায় সে রকম বোধ হয় আপন ছেলের কাছ থেকেও কেউ পায় না। সবুজ অতি বিনয়ী আর ভদ্র, কিন্তু বড় নির্বান্ধব। ওর একা একা থাকাটাই তাকে কষ্ট দেয়।

এই নারিকেল গাছতলায় একেবারে কাকভোরে সে দেখেছিলো ছেলেটাকে ঘুমিয়ে থাকতে। কি ভয়ংকর সে দিন সে সব। ভেবেছিলো হয়ত গলাকাটা বা পেটফুটানো অবস্থায় দেখবে। পুকুরের ওপারে এরকম প্রায়ই দেখতে হতো তাকে। টিনের টুকরো দিয়ে ঘষে ঘষে জবাই করা একটা দেহ দেখেছিলো একদিন, পাশে মাথা ছিলো না কিন্তু টিনের টুকরোটা পড়ে ছিলো, হয়ত জবাই করা মাথাটা ঢিল দিয়ে ছুঁড়েছিলো পুকুরে।

তারপর হঠাৎ একদিন তাকে প্রত্যক্ষদর্শী হতে হয়েছিলো। সেদিন সে খুব চুপিচুপি কেবলই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে অনুষ্ঠান শোনা শেষ করেছে, বালিশের পাশে কাঁথার তলায় লুকিয়ে রেডিওটা রেখে সে খুব কমিয়ে রাখা হ্যারিকেনটা একেবারে নিভাতে যাচ্ছে, তখন হঠাৎ কি মনে হলো, মনে হলো একটু কোরআন শরীফ পড়লে তার ভালো লাগবে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তার এতটুকু দোয়াও যদি কাজে লাগে সে হ্যারিকেন না নিভিয়ে বরং একটু উস্কে দিয়ে পড়তে থাকলো। পাঁচ ছয় মিনিট হয়েছে কি হয়নি তার কপাটে একেবারে দুমদাম ধাক্কা আর নাম ধরে ডাক। এই মাঝরাতের ধাক্কার মানে তখন সবাই বুঝতো। ইজ্জত লুটা, মেরে ফেলা, হয়ত ধরে নিয়ে যাওয়া, বাংগালী হলে এর বাইরে আর কোন কথা নাই। একটু কথা, প্রতিবাদ হলেই বয়োনেট দিয়ে এফোড় ওফোড়, স্ত্রী কন্যার ধর্ষণ দেখা নয়ত নিজগৃহে জলন্ত দগ্ধ হওয়া।

সাবের আলীর মেরুদণ্ডের মজ্জা পর্যন্ত কেঁপে উঠলো। পাশেই শুয়ে রয়েছে এক বছরের কন্যা নিয়ে স্ত্রী জরিনা। কি করবে, কোথায় লুকাবে তাকে? ওর ঘুম এখনও ভাঙেনি, তবে যে শব্দ করছে এক্ষুনি তা ভেঙে যাবে। ভয় পেয়ে চিৎকার করে দিলে তো লুকাবার প্রশ্নই উঠবে না। এরকম আচমকা দরজায় ধাক্কা পড়বে সে ভাবতেও পারেনি আগে। বরং বাইরে গুলির শব্দ হলে ওরা গিয়ে উঠানের কোনে ট্রেুনচে লুকাবে এটাই ঠিক করা ছিলো। তার বাড়িতো গণমাধ্যমের মধ্যে পড়ে, গ্রাম জ্বালালে তার বাড়ি পুড়বে, গ্রামে হানা দিলে তারা দলবদ্ধ হয়ে হয় মরবে নয় পালাবে। মনে প্রাণে দেশকে ভালোবাসলেও যুদ্ধ করার উপায় তার নাই। স্ত্রী ও কন্যাকে সে কোথায় কার কাছে রেখে যাবে? তেমন কেউ নেই তাদের তাই সে অপারগ। এদের রক্ষা করাই তাই তার বড় দায়িত্ব বলে মনে হয়েছে। তার বাড়িতে না মুক্তির আনাগোনা না রাজাকারের। তবে কেন? তার বাড়িতে কেন?

সাবের আলী দিশেহারা হয়ে যায়। কোরআন শরীফের অসম্পূর্ণ সূরা বিড়বিড় করে বলতে থাকে, বুকে কোরআন শরীফ চেপে ধরে কাঁপা হাতে দরজা খোলে। কোন উপায় নাই, দেরি করলে বরং তাড়াতাড়ি গুলি চলবে।

বরং সাবের আলী বিমূঢ় হয়ে দেখে তার কাঁধ থাপড়ে একজন মিলিসিয়া কাপড়ধারি তাকে বাহবা দিচ্ছে। পাক্কা মুসলমান বলে সাবাস দিচ্ছে। উর্দুতে বলছে, নিশ্চয়ই তুমি পাকিস্তানের জন্য দোয়া করছ?

সাবের আলীর ভাষা নেই মুখে। একটা চেনামুখ (রাজাকার) বলে উঠলো কি স্যার, দেখছেন না মুখভরা দাড়ি, মাথায় টুপি? আমি ঠিক জায়গায় এনেছি স্যার, এ আমাদের সাহায্য করতে পারবে, ওর বাড়ির পেছনে পুকুর আছে। আর ওর বাপ মা কেউ নেই। বিস্মিত সাবের আলী মুহূর্তেই আল্লাহর উপরে জান বাঁচানোর জন্য কৃতজ্ঞ হয়ৈ উঠল। একটু আগের হাতে নেওয়া কোরআন শরীফ আর মাথার টুপি, অথচ তার আগেই সে স্বাধীন বাংলা বেতার শুনছিল।

কিন্তু তার চেয়েও বিস্ময় লুকিয়ে ছিলো তার জন্য। তাকে হ্যারিকেন হাতে তাদের সাথে এগিয়ে আসতে বলা হলো। সাবের আলী ভয় পেলেও এটুকু নিশ্চিত ছিলো যে তাকে অন্ততঃ জানে মারবে না। সে এগিয়ে গেলো। ততক্ষণে স্ত্রী জেগে উঠেছে কন্যাও। ওরা তাদের ভয় পেতে নিষেধ করলো।

পুকুরের ধারে এসে হাত পা থরথর করে কেঁপে উঠল সাবের আলীর। দু’জন মানুষ। পিঠমোড়া করে হাত বাঁধা, সে জীবনেও কল্পনা করতে পারেনি এখানে সে এই দৃশ্য দেখবে।

সিপাইটা উর্দুতে বলল, এরা কাফের, এদের জন্য গুলি নষ্ট করতে চাই না, এদেরকে জবাই করব, তুমি একটু হ্যারিকেনটা ধরে থাকবে। এইসব কাফেরদের হত্যার মধ্যে ছোওয়াব আছে, দিলে আনন্দ আছে। তুমিও সেই ছোওয়াবের ভাগী হবে। আসো সাবের আলী হ্যারিকেনটা ঠিকমতো ধরো।

রাজাকারটা সেদিন সাবের আলীর সাথে হাত বাড়িয়ে হ্যারিকেনটা না ধরলে বোধহয় কাঁপতে কাঁপতে তার দুর্বলতা ধরা পড়ে যেতো, আর তাহলে ওই দুজনের মতো তাকেও জবাই হতে হতো।

এরপর থেকে মাঝে মাঝেই তাকে যেকে নিয়ে গেছে ওরা ঝিল, বিল আর খালের ধারে। হ্যারিকেনটা হাতে দাঁতে দাঁতে চেপে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে সে, মনে মনে লক্ষ কোটিবার আল্লার নাম নিয়েছে, ভেবেছে এর শেষ কোথায়? ওদের চোখ বাঁধা থাকতো বলে সাবের আলীর তবু একটু স্বস্তি হতো, মৃত্যুর আগে তার মুখটা অন্ততঃ দেখছেনা তারা। কেউ কেউ শেষ মুহূর্তে ভগবান ঈশ্বর বা আল্লার নাম না নিয়ে জয় বাংলা বলতো। সে সময় সিপাই আর রাজাকাররা হো হো করে হাসতো। তাতে সামিল করতো তাকেও। অন্ধকার রাতে হ্যারিকেনের আলোয় নিজেকে ভৌতিক পিশাচ বলে মনে হতো তার। কিন্তু সেদিন তেমন কোনো ব্যাপার ছিলো না রাতে। তবু ঘুম আসছিলো না সাবের আলীর। রাতগুলো তার কাছে বিভীষিকার মতো মনে হতো।

সে ধলপ্রহরের দিকে তাকিয়ে থাকতো, মাঝে মাঝে একা একা হাটতো, ভাবতো, একি কাক সে করছে। এ তার কোন কর্মের প্রতিফল? সে ভেবে পেতো না। জরিনা জিজ্ঞাসা কতো, ওরা তোমাকে কোথায় নিয়ে যায় রাতে? কি কাজে নিয়ে যায়? সাবের আলী বলতে পারে না বলে, এই আর কি। কি করে বলবে যে, হিন্দু ধরে এনে, সন্দেহভাজন মুক্তিদের ধরে এনে তাকে সাক্ষী রেখে  জবাই করা হয়? জরিনা কি তাকে তাহলে ক্ষমা করতে পারবে? তার ইজ্জত নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য শুকর গুজারী করবে? রাতে যে সাবের আলী আলো নিয়ে বাইরে যায় তা গ্রামের কেউ কেউ দেখলেও দেখতে পারে জানলেও জানতে পারে, কিন্তু কেউ তাকে মুখ ফুটে কখনও কিছু জিজ্ঞাসা করে না। সেও তাই একা থাকতে ভালোবাসে। আর নামাজ কালাম পড়ে। এমন কি রাতজাগা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে বলে তাহাজ্জুতনামাজ পড়ে। কাক ডাকা ভোরে সে হয় আযানের পর প্রথম নামাজি। সেদিন আল্লার কাছে তার কাজের ক্ষমা চাইতে চাইতে ফিরছিলো, হঠাৎ দেখে বাঁকা নারিকেল গাছটার নিচে ঘুমন্ত বালক। ছুটে গিয়ে দেখে, না আহত নয় একেবারে তাজা। ক্ষণিক ভেবেই কোলে তুলে ঘরে নিয়ে আসে ছেলেটাকে।

এই সেই সবুজ, প্রায় পাঁচ চয় বছরের শিশু বালক। কে বা কারা যে ওকে রেখে গেছে না হারিয়ে ফেলেছে রাতের আঁধারে পথ চলতে পালাতে গিয়ে কে জানে। বোধ হয় খুব ক্লান্ত ছিলো তাই ওর ঘুম ভেঙেছিলো অনেক বেলায়। জেগেই কাঁদেনি বরং ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছিলো, সে সময় সাবের আলী কাছে এগিয়ে গিয়েছিলো অকৃত্রিম স্নেহ নিয়ে।

সাবের আলীর মনে হয়েছিলো অনেক প্রাণ বিনাশের সে সাক্ষী বলে হয়ত একটা তাজা প্রাণ রক্ষার দায়িত্ব পড়েছে তার। সেই বিশ্বাস থেকেই সে সবুজকে নিজ সন্তানের মতোই মানুষ করেছে, আদর সোহাগ দিয়েছে, স্কুলে পড়িয়েছে, নিজ জমির বাইরেও বর্গা চাষ করে কলেজের বেদন দিয়েছে। সবুজকে মানুষ করে তোলায় কোন ত্রুটি রাখেনি।

সবুজের স্মৃতি থেকে একটু একটুবের করে নিয়ে খোঁজ খবর করেও সেখানে কাউকে খোঁজে পায়নি সে। অতটুকু ছেলে কতটুকুই বা বলতে পারে। বাবার নাম বলতে পারে কিন্তু জায়গার নাম বলতে পারে না। মামার নাম বলে, বলে, তারা নাকি মামার সাথে যাচ্ছিল। কিন্তু কোথায়, কিছু জানে না। সাবের আলী ভাবে একদম কিছু না বলতে পারত বরং সেটাই ভালো ছিলো। সবুজ তখন জরিনার শাড়ির আঁচল হাতের সাথে বেঁধে নিয়ে ঘুমাতো। হয়ত শিশু মন আবার হারিয়ে যাবার ভয়ে কাঁপতো। নাবের আলীর গলা আঁকড়ে ধরে থাকতো। ওকে না জাগালে সে বাইরে যেতে পারতো না।

একদিন রক্তের ছিটা কাপড়ে দেখে আঁতকে উঠেছিল সবুজ। জিজ্ঞাসু চোখ নিয়ে তাকিয়ে ছিলো। জরিনার কাছে ধরা পড়ার আগেই পুকুরে ধুতে ছুটে গিয়েছিল সে, পিছে পিছে উঠে এসেছিলো সবুজ। কি যেন কেন ওই উন্মুক্ত আকাশের নিচে শিশু সবুজের কাছে প্রাণ খুলে কেঁদেছিলো সাবের আলী। বুঝুক না বুঝুক বোধ হয় বলেও ছিলো কিছু। সবুজ চাচা বলে ডেকে উঠে আরও বেশি আঁকড়ে ধরেছিলো তাকে। তার হৃদয়ের ক্ষত বুঝি কিছুটা মুছে গিয়েছিলো সেদিন।

কিন্তু সবুজের ক্ষত সে কমবে কিসে। জরিনাকে চাচী ডাকে ময়নাকে বোনের মতোই ভালোবাসে তবু হারোনোর ব্যথায় কুকড়ে থাকে সবুজ।

সবুজের স্মৃতিতে মা তার হালকা নীল শাড়িতে জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। বাবা ফিরে আসবে বলে রোজ দাঁড়িয়ে থাকে। বড় হয়ে অমন জানালা, পায়নি। হয়ত খানসেনারা পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে।

কিন্তু মামা ওকে নিয়ে গেলো না কেন? বইতে ভারি হচ্ছিল নাকি গুলির ভয়ে হঠাৎ পালিয়ে গিয়ে আবার আর ফিরতে পারেনি? পরেরটাই হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু পরেও কি আর আসতে পারেনি, পথ চিনতে পারেনি, পথ চিনতে পারেনি? মামা না চিনুক সে চিনবে বলে কতইতো হাঁটলো সে।

সবুজ ভাবে, আশ্চর্য তার জীবন। কেউ নেই, আপন কেউ নেই তার।ভাগ্যিস নাটক সিনেমার মতো একটা চাচা পেয়ে গেছে নাহলে রেললাইনের কুলি বা টোকাই হওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিলো না।

এর ওর কাছে শুনে শুনে, পড়ে আর নিজে বুঝে, যুদ্ধের সময়ের একটা ছবি সে দাঁড় করাতে পারে ঠিকই কিন্তু নীল শাড়ি পরা মায়ের সাথে দৌড়াতে দৌড়াতে আর ঠাঁই খুঁজে পায় না। তখন সবকিছু অর্থহীন হয়ে যায়। বেঁচে থাকবারই কোন মানে খুঁজে পায় না।

ভাবে, চচা তবু তাকে পড়াচ্ছে। শুধু চাচার দিতে তাকালেই তার মানুষের প্রতি আস্থা ফিরে আসে। চাচাকে সে প্রাণ দিয়ে শ্রদ্ধা করে। কোন শক্তিতে একটা লোক অচেনা অজানা অনাত্মীয়ের জন্য এতো করে।

পড়লে সে অনেকদূরে পড়তে পারে, কিন্তু বুঝতে পারে খরচ দিতে চাচার কষ্ট হয়। স্কলারশীপ পাবার মতো করে পড়তে গেলে অনেক খরচ করে পড়তে হয়। তাছাড়া সময় চলে যায় তবু ক্লাস এগোয় না। বসে থাকতে হয় পরীক্ষা দিয়ে এক বছর, ভর্তি হয়ে থাকতে হয় এক বছর, তারপর ক্লাস শুরু হলে কতদিনে যে বছর গড়াবে তা বলা মুশকিল। তবে চাচার মধ্যে এতটুকুও ক্লান্তি সে কোনদিনও দেখেনি, বরং সে নিজেই হয়রান হয়েছে। বিরক্ত হয়েছে। সবকিছুর ছন্নছাড়া দেখে।

এই কি স্বাধীন দেশ যার জন্য আজও তার মা বাবা নেই? এই কি স্বাধীনতা যার জন্য কয়েক ঘন্টার নোটিশে তাদের হল ছাড়তে হয়? হলে রেইড হয় আর হল থেকে অস্ত্র বের হয়? তাহলেও হলে গোলাগুলি হয়, ছাত্ররা, ছাত্রের বুক ছিদ্র করে? রাতের আধারে গুম করে লাশ? এ দেশেরই কিছু ছাত্র নামধারী আর মানুষরুপী অমানুষ আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়। পক্ষ হয়ে কাজ করে স্বৈরশাসকের।

এই কি সেই বাঙালী, যাদের রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস? যে বাঙালী তাদের পূর্ব পুরুষ নিয়ে গর্ব করে? নাকি সবাই আজ সবুজের মতো? যাদের কোন পিতার পরিচয় নেই? কিন্তু তবু সে তো বাঙালী, না কি? সেই বাঙালী স্বত্ত্বাটুকু নিয়েই সবুজ ভাতে চায় অতীতের পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, ময়নামতি শিক্ষাসংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের কথা। প্রশ্ন আসে মনে অতীশ দীপঙ্কর কি এদেশেরই ছেলে? কতো এলোমেলো চিন্তাই না আসে সবুজের মাথায়। কেন এসেছিল ১৯৪৭? কি তার মূল্য?

১৯৫২র ঘটনা পৃথিবীর অনন্য ঘটনা, সে সময় জন্মেনি বলে সবুজের দুঃখ হয়। বড় খারাপ সময়ে তার জন্ম বরং আরও অনেক অনেক আগে যে কোন একটা বিদ্রোহের মধ্যে জন্মালে ভালো ছিলো। ফারায়েজী বিদ্রোহ, কৃষক বিদ্রোহ কিংবা সূর্যসেনের সময়ে। সে কোন আন্দোলনেই যোগ দিতে পারেনি, না একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। সবুজ ভাবে, ভাবতে ভালো লাগে তার বাবা পাক হানাদারদের হাতে নিহত হয়েছে, শহীদ হয়েছে। ভাবতে ভালো লাগে তার মামা নিশ্চয়ই মুক্তিযোদ্ধা ছিলো কিংবা অন্যান্য আত্মীয়দের কেউ না কেউ। নিশ্চয়ই রাজাকার বা আলবদর কেউ ছিলো না। কিন্তু উর্দুভাষী একটা ছেলের কথা স্মৃতিতে আসি আসি করতে করতে চলে যায় যেন, কে ছিলো? কে ছিলো? অথচ তার চেয়েও ছোটবেলার দু’একটা স্মৃতিতো তার মনে আছে। মার আদর, বাবার গম্ভীর মুখ, নীলশাড়ি?

সবুজের মাঝে মাঝে কাঁদতে ইচ্ছে করে, তখন আবার ভাবে যার শিকড়ই নাই তার আবার কান্না কিসের? তখন বড় নিষ্ঠুর হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে চাচাকে হত্যা করতে। এতো ভালমানুষী তার সহ্য হয় না। বাঙালীর হাজার বছরের ঐতিহ্যের শিকড় তখন তাকে ধরে রাখতে পারে না।

সে শিকড়হীন বলে তার কিছুই হবে না। সে চাকরি পাবে না, পড়া শেষের আগে কিংবা পরে তার কখনই গাড়ি বাড়ি হবে না। সে কারও মাধ্যমে বা কাউকে ধরাধরি করবার শক্তি রাখে না। চাচার এই কষ্ট করে পড়ানোতে যে কোন প্রতিফল নেই সে চাচা বুঝতে পারছে না। চাচা বুঝতে পারছে না রাধানী বা দেশের হালচাল। তাদের কোন জায়গা নেই। তাদের কিছু করার নেই শুধু আদমশুমারীর লোক বৃদ্ধি করা ছাড়া। প্রচণ্ড এক হাতাশায় নিস্তেজ লাগে সবুজের। ভালোমতো বাঁচবার অধিকার যখন তার নাই তখন মাথায় মৃত্যু চিন্তা এসে ভর করে। যেমন তেমন মৃত্যু নয়, স্মরণ রাখবার মতো মৃত্যু। সেই যুবকের মতো বুকে পিঠে লিখে নিয়ে. “স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক”। তবু হয়ত লোকে সবুজকে চিনতে পারতো, লোকে মনে রাখতো, একটা পরিচিতি হতো সবুজের।

সামান্য সময় মাত্র, তারপরই আবার থিতিয়ে যায় সবুজ। দেশের ডাকের চেয়ে অনেক আদর মেশানো ভরসা মেশানো চাচার ডাকের কাছে নিজেকে ধরা দিতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে ময়নার দুর্বোধ্য চাহনির অর্থ খুঁজে পেতে। তবু ভেতরে জ্বলে প্রচণ্ড আক্রোমের তাণ্ডব। সবুজ এক ঝটকায় বড়শি টেনে তোলে, মাছটা ছাড়িয়ে নিয়ে সজোরে আছড়ে মারে ডাঙায়।

 

আরও পড়ুন- আলাউদ্দিন আল আজাদের গল্প- জলটুঙি

Mostafizur Rahman
Mostafizur Rahman

Mostafizur Rahman is a professional content writer at CrawlText, specializing in SEO articles, blog posts, and web copy that drive engagement and conversions. With experience crafting clear, audience-focused content for almost all the niches, he delivers well-researched, optimized pieces on deadline. He combines editorial rigor with keyword strategy to boost traffic, authority, and reader retention across blogs, platforms, and newsletters.

Scroll to Top