প্রচ্ছদসাহিত্য

হাসান আজিজুল হকের গল্প

হাসান আজিজুল হকের গল্প

সরল হিংসা

মেয়েটি ঘণ্টাখানেক ধরে ফুটপাতে একটি গাছের নিচে বসে আছে। আজ সন্ধ্যাবেলা থেকে দুবার ক্ষতি হয়ে গেছে তার । একবার, সূর্য ডােবার একটু পরে । উপসর্গ একই। রকম। প্রথমে যেন সামান্য টনটন করে ওঠে তারপর কেমন করে যে যন্ত্রণাটা বুক থেকে উঠে ধুইয়ে ধুইয়ে শিরা উপশিরা বেয়ে মাথার দিকে যায়। সেখান থেকে আর বিদায় নেই। মাথা সহযােগিতা শুরু করে, ছােট ছােট দাঁত-অলা বিষভর্তি সাপ পাঠিয়ে দেয় তার দুই বুকে। তখন সে বাধ্য হয় ঢেলে দিতে । সাপের মতােই, কামড়ানাের পর মাথা হেলিয়ে সাপ যেমন বিষ ঢালে, তেমনি করেই ঘাড় কাৎ করে বুকের দুধ ঢালে সে একমনে। পানশে শাদা দুধ তার তলপেট বেয়ে নিচের দিকে যায়, কিছু উপচে পড়ে রাস্তা ডুবিয়ে দেয়। আজ সাত দিন হয় তার শেষ বাচ্চা নিঃশব্দে মরে গেছে। এই রকম ক্ষতি তার আজই দুবার ঘটেছে। সারাদিনে হামি একবার খে-দুধ হয়ে বেরিয়ে গেলু, তবে তাে আমি আর বাঁচিম-বসে বসে মেয়েটি আকাশ-পাতাল ভাবে। তিনটি ডাস্টবিন খোঁজা হয়ে গেছে তার, খানিক আগে নেমেছিল এক ড্রেনে, কিছুই মেলেনি। | মেয়েটিকে একেবারে নিঃস্ব মনে করার কোনাে কারণ নেই। মানুষের জীবনে পুঁজিপাটা কিছু আছেই! ঠিক জন্মমুহুর্তেই পটকে না গিয়ে বেঁচে বর্তে থাকলে পুঁজিপাটা কিছু তৈরি হয়েই যায়। তরুণীটিকে বেশ আপন করে নিয়ে কুটুম্বের মতাে জিগ্যেস করলে অনেক কথাই সে বলে ফেলতে পারে। যেমনই হােক, সে জেনেছে সংসার কেমন আর কাকেই-বা বলে পুরুষমানুষ। রীতিমতাে কাঠখােট্টা চেহারার, মােটা হাড়অলা, কাঁচা পিয়াজ রসুন মাটি আর ঘামের গন্ধ ভর্তি জ্যান্ত পুরুষমানুষের অভিজ্ঞতা তার হয়েছে। গলার কাছে দম এসে আটকে গেছে যেন মরণের আগের দশা, মটমট করে ভেঙে যাচ্ছে পাজর, ধুপধুপ শব্দে হৃৎপিণ্ডের ঘা পড়ছে টেকির পাড়ের মতাে, আগুনের স্রোত বইছে দেহে।

আপন সংসারে পুরুষের কাছ থেকে এইসব জেনেছে মেয়েটি। এরই কাছাকাছি আর এক স্মৃতি-শিশুকে খাদ্য দেওয়া। টনটন করে ওঠে বুক, চেয়ে থাকলেই যেন বাছার বড় হয়ে ওঠা দেখা যাবে। মায়ের দেহ থেকে শক্তি যায়, শিশু হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে বড় হয় আর এই আনন্দে হঠাৎ মাথা খারাপ হয়ে গিয়ে বেসামাল হয়ে চোখে জল নিয়ে, পশুর মতাে গলা থেকে ঘড়ঘড় শব্দ বের করে শিশুকে বুকের সাথে চটকানাে-মেয়েটি তাও জেনেছে। সে আরাে জানে খড়কুটো কঞ্চি দিয়ে তৈরি খোদলও তাে মানুষেরই ঘর, সেখানে স্বামী-শিশু থাকে। সেখানে থেকেই তাে সে দেখেছে, রসকষহীন শুকনাে প্রকাণ্ড প্রান্তরে চাঁদ ওঠে, বেঢপ কুঁড়েঘরের ছায়া পড়ে, মানুষেরা জন্মায়, বড় হয়, টপাটপ মরে গিয়ে মাটির তলায় সেঁধােয়। এইসব সাংঘাতিক জ্ঞানগম্যি আর বিস্ফোরক বুকে নিয়ে হঠাৎ মেয়েটি খেয়াল করে, যে গাছের নিচে সে বসে আছে তার কোনাে ছায়া নেই। কোথায় গেল ছায়া? গাছ তাে ভূত নয় যে তার ছায়া থাকবে না? মেয়েটির গা ছমছম করে ওঠে। তখন সে চেয়ে দেখতে পায়, গাছের সামনের আলাের তাড়া খেয়ে ছায়া হেলেছে পেছনে। সেটা দেখে আর এক চালকুমড়াের মতাে বড় শাদা আলাে রে রে করে তেড়ে এসে তাকে ভাগিয়েছে। আসলে তার জ্বর এসেছে। যখন সে পথের পাশে পা ছড়িয়ে বসে মাথার রুখু চুলে লম্বা নখ ডুবিয়ে পাগলের মতাে চুলকোতে থাকে, তখুনি কেবল মনে হতে পারে স্বামীর কথা আর তার মনে নেই, শােকের তাে প্রশ্নই ওঠে না। আর যখন দিনের মধ্যে বারকতক বুকের দুধ ঢেলে ফেলে দিতে হয়, তখনাে নেই কোনাে স্মৃতি, তা শুধুই যেন ক্ষতি-ডাস্টবিন-খোজা, ড্রেন-ঘাটা কত কষ্টের খাবার শরীরযন্ত্রের বিশ্রী নিয়মে বেরিয়ে যাবার ক্ষতি।

সে আবার রাস্তায় বেরিয়ে আসে। পূর্ণিমার চাঁদে যেমন আলাে হয়, চওড়া চওড়া রাস্তায় তেমনি আলাে। কালাে রাস্তার পিঠের উপর ঘন দুধ লেপে দেবার মতাে ব্যাপার। চঁাদ নেই, আকাশ দেখা যায় না। সামান্য একটু বাতাস ওঠে, এক মােড়ের কাছে এসে মেয়েমানুষটি কয়েকটি বড় বড় গাছের কথাবার্তার আওয়াজ পায় । গাছকে ঠিক গাছের মতােই দেখে তার আর ভয় হয় না। সে পার হতে যাবে মােটা, খুব পুরনাে বুড়াে একটা গাছের গুঁড়ির ভিতর থেকে এক মানুষ বেরিয়ে এসে তার পথ আটকে দাঁড়ায়। মেয়েটি খেয়াল করেনি, হুশ করে নাক-মুখ থেকে একগাদা বাতাস ছাড়ল লােকটা তার মুখের উপর । সে চেয়ে দেখে মােটা থলথলে আ-গড়া এক বামন তার সামনে দাঁড়িয়ে। জলের নিচে অনেকক্ষণ দম আটকে রেখে ভেসে উঠলে লােক যেমন হাস হাস করে নিশ্বাস ফেলে, বামনটা ঠিক তেমনি করে তার মুখের উপর শ্বাস ফেলতে থাকে। একটু আলাে এসে পড়ে লােকটার মাথায়, মেয়েটি দেখতে পায় চক চক করছে তার টাক, কপালের মাঝখানটা অনেকটা দেবে বসে গেছে। দুজনেই একসঙ্গে বলে, কী? | মেয়েটির গলায় জোর বেশি, তার প্রশ্নই শােনা যায়। সাড়া পেয়ে গাছগুলাে চুপ করে যায়। _ মেয়েটি আবার তীক্ষ্ণ গলায় বলে, কী চাস তােরা? | বামনটি চট করে একবার টাকে হাত বুলিয়ে নেয়, তারপর বেঁটে বেঁটে গলে-পড়া : হাত ঢুকিয়ে এ-পকেট সে-পকেট হাতড়ে কী যে সে খুঁজে বেড়ায় সে-ই জানে। তেমনি। করে তার নিশ্বাস ফেলা চলতে থাকে, ছেলা লিচুর মতাে তার চোখ কেবলই বেরিয়ে আসতে চায়। চোখের দুটি গর্তই কানায় কানায় জলে ভর্তি, পানশে মণি দুটি সেখানে হাবুডুরু খাচ্ছে। যা খুঁজছে তা বারবার পেয়েও লােকটা পকেট থেকে হাত বের করতে পারছে না যেন। শেষ পর্যন্ত বাঁ হাতে একমুঠো টাকা বের করে এনে সে মেয়েটির মুখের সামনে সামান্য নাড়াতে থাকে, অন্য হাতে প্রথমে মেয়েটির কাধ স্পর্শ করে। ফলে কী যে হয় তার এক ঝটকা মেরে মেয়েটির বুকের সামান্য কাপড়-টুকরােটা সে ফেলে দেয়। মাটিতে। এরপর প্রবল ঝাঁকুনি খেয়ে তার ডান হাত মেয়েটির বুকে গিয়ে স্থির হয়।

হাসান আজিজুল হকের গল্প

এতক্ষণে লােকটা মুখ বন্ধ করে, নাকের ছ্যাদাও তার বন্ধ হয়ে যায়, গলার কাছে নিশ্বাস এসে আটকে গেলে মেয়েটি মানুষটার বুকের দ্রাম দ্রাম আওয়াজ শােনে একটু কান পেতে । ক্রুদ্ধ বিড়ালীর মতাে ধনুক-বাঁকা পিঠ করে সে চাপা গর্জন করে ওঠে। দুরত্তি নীলচে আলাে ঠিকরে বেরিয়ে আসে তার চোখ থেকে, দুই বুক ঝনঝনিয়ে ওঠে। সে শুধু বলে, এইঠে না, এইঠে না। বামন কোনাে কথা বলে না; সে যেন বাসরঘরে। তার নতুন কনে দেখছে। মেয়েটি বুকের উপর থেকে তার হাত সরিয়ে দেয় না, শুধু নিশ্বাসের সঙ্গে সামান্য পরিমাণ তীব্র বিষ মিশিয়ে আবার বলে, এইঠে না, এইঠে না। আস্তে আস্তে নিশ্বাস ছাড়ে লােকটা। কী লম্বা, গােটানাে ফিতের মতাে সেই নিশ্বাস, শেষ হতে চায় না। কোথায় যাব কোনদিকে যাব বল ।

হেঁট হয়ে মেয়েটি কাপড়ের ফালি কুড়িয়ে নিয়ে বুক ঢাকে, শক্ত করে লােকটার হাত চেপে ধরে, চল জায়গা আছে বলে হনহন করে সে এগােতে থাকে। বেঁটে, আ-গড়া, পিণ্ডাকার বামন বলির পাঁঠার মতাে পিছু পিছু চলতে শুরু করে। কিসব মারাত্মক প্যাচ রাস্তাগুলােয়—এই সব দুধলেপা কালাে অদ্রি রাস্তাগুলােয়! একবার মেয়েটি মুখ ফেরাতেই বামন বলে, একটু আড়াল চাই, একটু আড়াল চাই যে! |

আড়াল পাওয়া যায় । কোমর পর্যন্ত উঁচু আগাছা আর বুনাে লতাপাতার ঘন আড়াল ।। রাস্তা, ফুটপাত আর ভেঙে পড়া কাঁটাতারের বেড়ার পাশেই। মরচে পড়া টিন, ফাটা হাঁড়িকুঁড়ি আর তােবড়ানাে কৌটোর উপর দিয়ে যাবার সময় খানিকটা শব্দ হয়। | বামনের হাতের মধ্যে নােটগুলাে দুমড়ে-মুচড়ে রয়েছে। মেয়েটি বলে, টাকা আগে দিমেন?

লােকটা বলে, দেব না কেন? নিশ্চয়ই দেব। কোথায় রাখবি এখন টাকা? সে করুণার সঙ্গেই বলে। সে যে দেখতে পেয়েছে মেয়েটির কোনাে আড়াল নেই! তােরা কুনঠে রাখিমেন? বামন খেয়াল করে তারও কোনাে আড়াল নেই।

মেয়েমানুষ হাত বাড়িয়ে বলে, হাতে দে, হাতে রাখিম। তার হাতে টাকা দিয়ে সেই হাত আর ছাড়ে না লােকটা। সমস্ত নগর তার চারপাশে ঘুরতে থাকে। এখন সে টিকিট কেটে গােলকধাধায় ঢুকে পড়েছে। ঘুটঘুটে আঁধার, বুকচাপা সরু সরু সংখ্যাহীন গলির মধ্যে ঢুকেই তার প্রাণ হিম হয়ে যায়। ধার-তােলা ভয়ানক গলায় মেয়েমানুষ মাত্র একটি কথাই বলে, কই, কুনঠে তুই? সে দেখে, অন্তহীন অফলা মাঠে চাঁদের দিকে মুখ তুলে একদল গাধা গান গেয়ে যায়, তার বুকের দুধে মাটি ডুবে যায়, এক ঠ্যাং আকাশে তুলে, এক চোখ খুলে রেখে সাতদিন আগে মরা তার ছেলে সেই দুধে শােলার মতাে ভাসতে থাকে। মেয়েমানুষ সেইখানে উলঙ্গ দাঁড়িয়ে চুল ছড়িয়ে ডাকিনীর মতাে হাত বাড়িয়ে কয়েকবারই বলে, কই, কুনঠে তুই?

পাঁচ হাত দূরের আগাছা জঙ্গলের ভিতর থেকে একেবারে আচমকা এক তীক্ষ কণ্ঠ বলে ওঠে, এই যে সায়েব, আমাকে দ্যাখেন, আমাকে ল্যান। আমাকে লিবেন? একটি মেয়েমানুষ উঠে দাঁড়ায়। বামনের যেন বাজের শব্দে কানে তালা ধরে গেছে, পয়সা দেওয়া মেয়েটিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে সে চেঁচিয়ে ওঠে, ও বাবা! ঝােপ থেকে বেরিয়ে আসে মেয়েটি, এই যে সায়েব, আমাকে দ্যাখেন, ঐ পেত্নীর চেয়ে আমি অনেক সােন্দর, আমারে মাত্তর এট্টা টাকা দিবেন । দ্যাখেন, আমি দ্যাখাই, দ্যাখেন- হ, কইছে তরে, পােড়া কপাইলা মাইয়া-আরেকটি মেয়ে যে কোথা থেকে হাজির হয়। বলা মুশকিল।

সামনে, পিছনে, রাস্তার দিকে থেকে, আলাের ভিতর দিয়ে অন্ধকার সরিয়ে মেয়েমানুষেরা এগিয়ে আসে-সাত আটটি মেয়েমানুষ। তারা এসে বামন মানুষটিকে ঘিরে ধরে। তীব্র বাক্যের তীর তাদের নিজেদের দেহ ছিন্নভিন্ন করতে থাকে। প্রাণঘাতী গালাগালি ঝিকিয়ে ওঠে। তারা নড়ে চড়ে। আলাে ও অন্ধকার পালটাপালটি তাদের উপরে এসে পড়ে। আধপােড়া মানুষের মতাে তাদের দেহে শাদা আর কালাে রঙের ক্ষত। বােবা বামনটির দিকে তারা ঘুরে-ফিরে সেলাম ঠোকে, এই যে সায়েব, দ্যাখেন, মাত্তর এট্টা টাকা আমারে দিবেন । তালিই হইবে। এইভাবে জয়তুন, তসিরুন, চেঁপি, গােলাপি, পুষ্প ইত্যাদি তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে যায়।

জয়তুন বলে, এই যে সায়েব, দ্যাখেন, দয়া করেন, আমি তিনদিন কিছুই খাইনি, আমি সাতক্ষীরে থে আইছি। আমি তাে আপনার থে টাকা চাইনে। এই মাগি, চুপ কর-আমি সায়েবরে তর আগে কইয়া সারছি। হােনছেন সায়েববিনিয়ে বিনিয়ে পুষ্প বলে, বাবু দয়া হবে না, ও বাবু দয়া হবে না আপনার?  ও বাবু গাছগুলাে থেকে ছায়ারা নেমে দুদ্দাড় পালাতে থাকে, শাদা আলাে দাঁত খিচিয়ে তাদের তাড়া করে বেড়ায়। সৎ সৎ করে দূরে মােটরগাড়ি ছুটে চলে যায়। মাথায়, কপালে, অবশ উলঙ্গ জানুতে বরফের কুচি নিয়ে হিম শাদা বিবর্ণ বামন দাঁড়িয়ে থাকে, বুকের কাছে আত্মরক্ষার মতাে করে একহাত তুলে, আর এক হাত ঝুলিয়ে, দুই ঠোটের ফাঁক দিয়ে মােটা বাসি জিভটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে। গােলাপি বলে, সায়েব কেন কথা বলে না। টেপি বলে, বাবুর মুখে কথা নাই ক্যান্? জয়তুন বলে, সায়েবের দেখি দয়া নেই!

তসিরুন কোনাে কথা বলে না। পয়সা-দেওয়া মেয়েটি একটু দূরে গিয়ে গুটিশুটি মেরে বসে পড়ে। টাকার নােটের উপর আঁটো হয়ে বসে যায় তার হাত। খুলতে গিয়ে। সে খুলতে পারে না।

জয়তুন আবার বলে, সায়েব, পুলিশ এদিগে আসবে না। দ্যাখেন, একমাসে আমার তিনভে বাচ্চা মরিছে আর মাত্তর এড়া আছে ।

পুষ্প আগের মতােই বিনিয়ে বিনিয়ে বলে যায়, দয়া হবে না বাবু, আমার বাচ্চা নেই, সােয়ামি মরতিছে, আমার সঙ্গে চলেন বাবু, সােয়ামি মরতিছে দেখাতি না পারলি আমি বাপভাতারি।

হাসান আজিজুল হকের গল্প

এই কথা শুনে মেয়েরা হিহি করে হেসে ওঠে। পুষ্প গলা না তুলে আবার বলে, তাহলি আমি বাপভাতারি। গােলাপি আদুরে গলায় হাসি থামিয়ে বলে, সায়েব আমার পতি নাই। | মেয়েরা আবার হেসে লুটিয়ে পড়ে, তসিরুন বলে, র, আজ রাত্রকালে তর পতি জোটায়ে দিমু। সায়েব, এই মাইয়াটা খুবই ভালা, কোনাে পুরুষে হ্যারে আজও ধরে নাই, মােরে এট্টা ট্যাহা দিয়া হ্যারে আজ বিয়া করেন, দোহাই আপনের। তাদের হাসিতে আস্তে আস্তে বালি কিচকিচ করতে থাকে। মুখের কথা গিয়ে পড়ে সেই ঝকঝকে কিচকিচে বালিতে, তাতে শান পড়ে, ধার বাড়ে। কথার ভয়াবহ বর্শা বামন মানুষটির দেহ ফুড়ে ফুড়ে বেরিয়ে যায়। হাড় পাঁজর ফুসফুস ভেদ করার সময় কেমন গা শিরশির করা সিঁৎ সিৎ শব্দ হয়। জয়তুন বলে, সায়েবের দয়া নেই শরীলে ।। শেষে তসিরুন বলে, ল, সায়েবরে তয় খেলা দ্যাখ্যাই।

এই কথা বলে সে ঘুরে গিয়ে বামনের সামনে দাঁড়ায়, সায়েব এত কই, মােরে বুজি মনে লয় না আপনের? তবে দ্যাহেন মাের শরীলটা, এই যে দ্যাহেন-বলে একটানে সে কাপড় যা ছিল ফেলে দিয়ে ন্যাংটো হয়ে যায়। খুব বড় শরীর তার, ভাল দুধেল গাইয়ের মতাে, নিচের দিকটা ভারি, বিশাল বুক, শক্ত জাহাবাজ ঘাড়।। তবে আমারেও দ্যাখেন- জয়তুন তসিরুনের পাশে দাঁড়ায়। সেও সময় নেয় না।। এই মেয়ে শুকিয়ে রসহীন, পেট সেঁটে গেছে পিঠের সঙ্গে, দ্যাখেন, চারডে বাচ্চা হইছে, আমার দোষ কি, ও সায়েব দ্যাখেন, বয়েসকালে ভালাই ছেলাম। এখন আমার শ্যাষ বাচ্চাডা মরতিছে।

মাের পােলাডা রাইখ্যা আই। মুইও দ্যাখামু-টেপি ফুটপাতের কাছে গিয়ে একটা কালাে নােংরা মানুষের ছানা রেখে ফিরে এলে ঝিঝি পােকার একটানা ডাকের মতাে একটা ই ই ই শব্দ হতে থাকে। এইবার বামনকে ঘিরে উলঙ্গ মেয়েমানুষেরা দাঁড়িয়ে যায়। স্বচ্ছন্দ নির্বিকার ন্যাংটো মেয়েদের একটি দঙ্গল। এতক্ষণে পয়সা মিটিয়ে-দেওয়া মেয়েটিও আস্তে আস্তে উঠে এসে সারিতে দাঁড়াতে যায়। এখন আর তার কোনাে। আড়ালের প্রয়ােজন নেই। তুই ক্যানে লা এখেনে? বজ্জাত পেত্নী কোথাকার! তার চোখে ধক করে আলাে জ্বলে ওঠে, সায়েব মােক টাকা দিছে।

এই যে সায়েব, আমরা সবাই দাড়াইছি আপনের ছামনে- আমাদের মধ্যে থিকা কারে নিবেন ন্যান-পসন্দ করেন একজনরে । | বামন মানুষ চুপ, ফুটপাত থেকে একটানা ঝিঝির ডাক শােনা যায়। তীব্র চোখে মেয়েরা তার দিকে চেয়ে থাকে। সামান্য দড়িতে প্রচণ্ড ভার ঝুলছে এইরকম মনে হয় নগরী। তবু চুপ ক্যান? কাকে নিবেন ঠিক করেন। মেয়েদের কেউ হাই তােলে, কেউ চুল ঝাড়ে, কেউ কোমরে হাত রেখে এক পা একটু সামনে বাড়িয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

ছিড়ে যায় শেষ পর্যন্ত। পুষ্প লােকটির একহাত ধরে আচমকা হ্যাচকা টান দেয় সামনের দিকে, বাবু চুপ ক্যানাে, জিভা কি খসে গেছে? বামন হুমড়ি খেয়ে পুষ্পের উপর পড়তে পড়তে বলে, দোহাই, আমাকে ছেড়ে দাও তােমরা।

জয়তুন বলে, কী কথা কন সায়েব? আপনের দয়া চাইনে আমরা, ভিক্ষে না, জিনিশ নে দাম দ্যান। বামন আবার বলে, আমাকে ছেড়ে দাও, দোহাই তােমাদের । তসিরুন জবাব দেয়, ওসব চলব না, আমাদের থিকা একজনরে পছন্দ করনই লাগব আপনের। এই আমারেই পছন্দ করেন, বলে তার হাত ধরে টানে।। না, মােকে, বলে জয়তুন তার আর এক হাত ধরে।

তখন আরম্ভ হয়। নিজেদের মধ্যে তাদের সঙ্গীতের সমন্বয়। অতি চমৎকার ভারসাম্য । কেউ ধরে বামনের হাত, কেউ ধরে পা। কেউ চুল বা কোমর। এদের খপ্পর থেকে লােকটা যেতে চায় তার ছেডেরাখা পাজামাপাঞ্জাবির দিকে। পাঞ্জাবির পকেটে টাকা আছে একথা তার মনে পড়ে না। তার আড়াল চাই। বাঘিনীর মতাে ঝাপ দিয়ে পড়ে তসিরুন । লােকটার জামা মুহুর্তে ছিড়ে ফালা ফালা করে ফেলে। পকেট থেকে একগােছা নােট পড়ে গেলে সে সেগুলাে কুড়িয়ে নিয়ে লােকটার সামনে এসে বলে, দ্যাখ সায়েব, তর টাকার। হাল দ্যাখ। প্রচণ্ড আক্রোশের আগুন বেড়িয়ে আসার পথ না পেয়ে তার বুকে আড়াআড়ি আটকে গেলে যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত হয়ে ওঠে। আগুনটা চোখ দিয়ে বের করতে করতে সে কুচিকুচি করে ছিড়ে উড়িয়ে দেয় নােটগুলাে, তারপরেই আবার লাফিয়ে পড়ে লােকটার উপর, আমাদের একজনরে তর পছন্দ করাই লাগব, ছাড়ান নাই তর।।

হাসান আজিজুল হকের গল্প

হাতে নােট-ধরা প্রথম মেয়েটি একটু দূরে দাঁড়িয়ে নিঃসাড়ে কাঁদে। অফলা মাঠে বাপ হারিয়ে যাওয়া দিশেহারা বালিকার মতাে। কী দেখে সে? ভােরবেলার চাঁদ তাড়াতাড়ি মাঝ-আকাশে চলে যাচ্ছে, কাঞ্চনজঙ্ঘা জাগছে, পূর্বকোণে আগুন লেগেছে দিগন্তে, তারই শাদা ধোয়ায় মাঠ ভরে যায়। সেই দিকে চেয়ে মেয়েমানুষ নিঃশব্দে কাদে। ওদিকে বামন মানুষটিকে হাতে হাতে লােফালুফি করে জয়তুন, টেপি, তসিরুন আর গােলাপির দল। পুষ্প তার ঘাড়ের কাছে নখ ডুবিয়ে ধরে, কথা নেই মুখে তর, মুখে কুঠ নাকি, ও বাবু? প্রচণ্ড ধাক্কা দেয় সে। ছিটকে পড়ে বামন। প্রায় সাথে সাথেই তসিরুন গুঁজে ধরে তার ঘাড়, নষ্ট করার মতাে একটি মুহূর্তও তার হাতে নেই। কোন কথা সে বলে না, তার পিঠের উপর চেপে বসে প্রাণপণে হাত চালিয়ে যায়। শেষে তসিরুনকে টেনে সরিয়ে জয়তুন বলে, মিনসে কি তােরে একা পছন্দ করিছে? সরে আয় কচ্ছি। সবাই মিলে চিৎ করে শুইয়ে দেয় লােকটাকে। বামন সব চেষ্টা ছেড়ে দেয়, দুহাত ছড়িয়ে দেয় দুদিকে, মেলে দেয় দুই পা যতদূর যায়, একটা গােল আলাে ঠিক তার মুখের উপরে এসে পড়ে, শাদা চোখ দুটিতে তার কী এক ভয়ঙ্কর কষ্ট। সেই মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে লােকটির মৃদু নিশ্বাসের স্বাদ নিতে নিতে জয়তুন দুই হাত একসঙ্গে করে তাকে ঠেঙিয়ে যায়। মেয়েরা কিছুতেই তাকে সেখান থেকে নামাতে পারে না। বাধ্য হয়ে তারা যেখানে সুবিধে পায় সেখানেই লাথি বসায়, মাংসের মধ্যে নখ ডুবিয়ে দেয় কিন্তু কেউই কোনাে কথা বলে না।

সমান তালে লােকটার ঘূণা কি ভালােবাসা, আক্রোশ বা কষ্টের নিশ্বাস চলতে থাকে : তার চোখের ভাব বর্ণনার যখন আর কোনাে আশাই নেই, তখন তসিরুন একা সবাইকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে তার মুখের উপর দুই পা তুলে দাঁড়ায়। এইবার আপন বুকে দুহাতে দমাদম আঘাত করতে করতে সে নগরীর দিকে চেয়ে খলখল করে হেসে ওঠে।

 

আরও পড়ুন- শিল্পী নাজনীনের গল্প- স্মৃতিভ্রষ্ট পরিব্রাজক

error: Content is protected !!