স্মৃতিভ্রষ্ট পরিব্রাজক: শিল্পী নাজনীন এর গল্প
কিছুই মনে পড়ে না আমার। কে আমি, কী আমি, কোথায় ছিলাম, কোথা থেকে এসেছি, কিছুই না। আমার কোনো স্মৃতি নেই। না পূর্বজন্মের, না এ জন্মের। বতর্মানটাই আমার কাছে একমাত্র সত্য। ধ্রুব। আমি নিজেকে আবিষ্কার করেছি এই প্রবাহমান সময়ের ক্ষুধাতুর উদরে। কিন্তু আমি কে? কোথা থেকে এখানে এসেছি? কীভাবে, আর কেনই বা? আমার এলোমেলো লাগে সব। অচেনা। আমার চারপাশের প্রবাহময়তা আমাকে গ্রাস করতে চায়। গিলে ফেলতে চায়। ঠিক তখনই কোত্থেকে একটা ট্রেন হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে আমার চোখের নাগালে, কিলবিলিয়ে সেঁধিয়ে যায় স্টেশনের জনাকীর্ণ চৌহদ্দির ভেতর। ট্রেনটা ক্ষণিকের জন্য থামে। একদঙ্গল লোককে লহমায় উগড়ে দিয়ে আরেকদঙ্গল গিলে নেয় ক্ষুধার্ত বাঘের মতো।
তারপর আবার ফণা তুলে ছুটে যায় বিশাল অজগর। মুহূর্ত পরেই হারিয়ে যায় দৃষ্টিসীমা থেকে দূরে। আমিও কি এমন কোনো ট্রেনের যাত্রী ছিলাম? কিংবা কোনো অন্ধকারের দেয়াল ভেঙে আছড়ে পড়েছি এই আলোক উপত্যকায়? না-কি এ সকলই আমার দৃষ্টিভ্রম! কেবলই কুহেলিকা! শুধুই প্রপঞ্চ! যাকে, যে বর্তমানকে আলোক উপত্যকা ভাবছি আমি, সে আসলে মরীচিকা, কোনো অস্তিত্বই নাই তার? আর এই যে ট্রেন, ছুটে গেল আমার বোধের সাঁকো দুলিয়ে দিয়ে, চলে গেল আমার অস্তিত্বকে নাড়িয়ে দিয়ে, সে-ও কি অলীক কিছু? আমারই কল্পনায় বিচরণ শুধু তার? তারও কোনো অস্তিত্বই নাই আদতে? বুঝতে পারি না। কিন্তু আমি, এই যে নিজেকে দেখতে পাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি চারপাশের জনস্রোত, কোলাহল, অনুভব করছি নিজের নির্ভার অস্তিত্ব, সেটাই বা কী করে অস্বীকার করা যায়!
কিন্তু আমার কিছুই মনে পড়ে না পূর্বাপর। কেন আমি বসে আছি এখানে? কোথা থেকে এসেছি আর কোথায় যাব? কিছুই মনে করতে পারি না আমি। এই জনাকীর্ণ স্থান, মানুষের ব্যস্তসমস্ত ছুটে চলা, স্টেশনে ট্রেনের আসা-যাওয়া, ঘণ্টার শব্দ, বাঁশির আওয়াজ, চিৎকার, চেঁচামেচি তথা এখানকার এই তাবৎ বতর্মানটুকু ছাড়া আমার স্মৃতিতে আর কিছু নেই। কখনও ছিল কি-না সেটাও ভীষণ অস্পষ্ট আমার কাছে, অনিশ্চিত। এটুকুই আমার পৃথিবী এখন, আমার পরিসর। আমি অলস বসে থাকি। কোথাও ফেরার তাড়া নাই। কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নাই। কোনো গন্তব্য নাই আমার। নাই চেনা কোনো গতিপথ। তাহলে আমি কেন বসে আছি এখানে? এরই বা প্রয়োজন কী? এখানে, এই অলস বসে থাকার কারণ খুঁজে খুঁজে হাঁপিয়ে উঠি আমি। ঘেমে যাই।
তারপর এই ভেবে হাল ছেড়ে দেই যে, হয়তো এই বসে থাকাটুকুই কাজ আমার। হয়তো কোনো নিগূঢ় অর্থ আছে এরও, আছে কোনো অব্যাখ্যেয় প্রয়োজন, যা আমি শনাক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছি আমারই অজ্ঞানতায়। আমি এবার মনোযোগী হই আমার চারপাশের কলকোলাহলে। ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার পর স্টেশনটা কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে। অল্প কিছু মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইতস্তত। কিছু ফলবিক্রেতা ফলসমেত ঝুড়ি নিয়ে বসে ঝিমুচ্ছে। ঝুড়ির ওপর লালমাথা মাছি সদলবলে উড়ছে বনবন। স্টেশন থেকে কয়েকগজ দূর দিয়ে দুটো পাকা রাস্তা ঠ্যাং ছড়িয়ে দিয়েছে আড়াআড়িভাবে। ব্যস্ত রাস্তায় লাল নীল লাইট নিয়ে গাড়িগুলো দৌড়াচ্ছে তুমুল ব্যস্ততায়। হঠাৎ কী একটা হয়। একদিকের যান চলাচল থেমে যায়। কানে ভেসে আসে তীব্র গর্জন। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো এসে আছড়ে পড়ে কানে। এই তীব্র তীক্ষ্ণ গর্জন থেকে শব্দগুলো আলাদা করার চেষ্টা করে আমার শ্রবণেন্দ্রিয়। বাছাই করার চেষ্টা করে চেনা শব্দ। ক্রমশ কাছে চলে আসে গর্জন। একটা মিছিল পাশ কাটিয়ে যায় স্লোগানে স্লোগানে। কয়েকটা শব্দ চেনা লাগে। কয়েকটা বাক্য।
স্বৈরাচারীর কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও।
স্বৈরাচারের মসনদে আগুন জ্বালো একসাথে।
স্বৈরাচারীর গালে গালে, জুতা মারো তালে তালে।
গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক।
স্লোগানগুলো তিরের ফলার মতো এসে বিঁধে যায় আমার চেতনায়। কে স্বৈরাচার, কার হাত কে ভাঙবে, কার মসনদে কে আগুন জ্বালবে, কার গালে কে জুতা মারবে কিছুই বুঝতে পারি না আমি। কিন্তু স্লোগানগুলো মাথার ভেতর দারুণ ছন্দে ঘুরপাক খায় অবিরাম। তীব্রভাবে আন্দোলিত করে আমাকে। ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক,’ স্লোগানটি করোটিতে ঢুকে যায় সহসা। গেঁথে যায় আমূল। কণ্ঠ চেরা তীব্র চিৎকারে আমিও দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলে উঠি, ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’…
আমার কণ্ঠ স্লোগানের তীব্র গর্জনের সাথে মিশে যায়। সমুদ্রের ফেনিল ঢেউ হয়ে ছড়িয়ে যায় হাওয়ায়। প্রচণ্ড শক্তিতে প্রতিধ্বনিরূপে আছড়ে পড়ে শহরের পলেস্তারা খসা পুরনো দেয়ালের পলকা শরীরের ভাঁজে ভাঁজে। মনে হয় তার আঘাতে বুঝি ভেঙে পড়বে শহর। বুঝিবা ভেঙে পড়বে স্বৈরাচারের পলকা মসনদ। তারপর একসময় ক্ষীণ হয়ে আসে স্লোগানের শব্দ। মিছিলটা পাশ কাটিয়ে চলে যায় ধীরে। আমার মুষ্টিবদ্ধ হাত শিথিল হয়ে আসে। আবার অলস বসে থাকি আগের মতোই। শহরটা কোনো কড়া সিদ্ধির ঘোরে ঝিমোয়। হঠাৎ হঠাৎ দু চারটে মোটরযানের শব্দ আর রিকশা বা ভ্যানের টুংটাং আওয়াজ তার ধ্যানে চিড় ধরাতে চায়। ভর দুপুরে মানুষগুলোও কাজ ভুলে খানিক বিরতি খোঁজে। রৌদ্রের খরতাপ এড়িয়ে স্বস্তি চায় দু দণ্ড। দূর থেকে কারা যেন হেঁটে আসে। তাদের নাতিদীর্ঘ ছায়াগুলো ক্রমশ ছোট হতে হতে বামন রূপ নেয়। সেদিকে তাকিয়ে কেন কে জানে, আবছা কী যেন একটা স্মৃতি মনে পড়তে চায় আমার। মনের কোণে অতি অস্পষ্ট ছায়া ফেলেই আবার সেটা অদৃশ্য হয়ে যায় মুহূর্তেই।
হঠাৎই ভীষণ চঞ্চল হয়ে ওঠে মন। অস্থির লাগে খুব। মনে হয়, কী যেন একটা মনের ভেতর উঁকি দিয়ে আবার হারিয়ে যায় শূন্যে, ধরা দিতে চেয়েও পুনরায় মিলিয়ে যায় অধরায়। যেন অতল জলের আয়না সরিয়ে কোনো অচেনা মাছ তার রুপোলি ঝিলিক দেখিয়ে সহসা লুকিয়ে যায় অন্তহীন জলে। দূর থেকে হেঁটে আসা ছায়াগুলো স্পষ্ট হয়ে আসে ধীরে ধীরে। স্টেশনের প্লাটফর্মের দিকে এগিয়ে যায় তারা নীরবে। আমি তাকিয়ে থাকি সেদিকে, পলকহীন। কয়েকজন জীর্ণশীর্ণ মানুষ। নারী ও পুরুষ। ট্রেনের অপেক্ষায় অধীর বসে থাকে। নিজেদের ভেতর কী নিয়ে আলাপ করে, এত দূর থেকে ঠিক বোঝা যায় না। আমি অলস বসে থাকি। দেখি। আবার ঘণ্টা বাজে। আবার ট্রেন আসে হুড়মুড়িয়ে। জীর্ণ মানুষগুলো নড়েচড়ে বসে। তুমুল ব্যস্ততায় উঠে পড়ে যে যার অবস্থান ছেড়ে। এক নারী অল্প বয়সী মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কাঁদে। সদ্য বিয়ে হওয়া মেয়েটার শ্বশুরবাড়ি যাত্রার শোকে মুহ্যমান মা মেয়েকে ট্রেনে তুলে দিতে এসে ভেঙে পড়ে কান্নায়। অন্যরাও চোখ মোছে ঘন ঘন। অদূরে ট্রেন থেকে নামা এক পরিবারকে সাদরে বরণ করতে এসে আনন্দে জড়িয়ে ধরে স্বজনেরা। একই মুদ্রার উল্টো দুটো পিঠ দেখে আবার কী যেন একটা চলকে ওঠে আমার মনের কূলহীন নদে। ঝাপসা। মনে হয়, বহুকাল আগে কে যেন এমনি করে জড়িয়ে ধরেছিল আমায়, ভালোবেসে, আদরে, আশ্লেষে, মমতায়। মনে হয় দূরে, বহুদূরে কে যেন পথ চেয়েছিল আমার। আমারই বিদায়ক্ষণে কে যেন এমনি করে কেঁদেছিল আমার বিরহব্যথায়, এমনি করে কে যেন কবে ঝরিয়েছিল তার দুচোখের মুক্তোবিন্দু আমারই জন্য ধরে রাখা হীরন্ময় বোধে। কে সে? কোথায়? কিছুই মনে পড়ে না। শুধু চোখের সামনে থেকে আবার অদৃশ্য হয়ে যায় ট্রেন, পাতলা হয়ে আসে ভীড় আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে চঞ্চল, অস্থির হয়ে ওঠে আমার স্মৃতিভ্রষ্ট মন। কেবলই মনে হয় কেউ একজন পথ চেয়ে আছে আমার।
ব্যাকুল প্রত্যাশায় অধীর, উন্মুখ হয়ে আছে সে, হয়ে আছে তিয়াসাব্যাকুল। তার জন্য কেঁদে ওঠে মন, হাহাকারে ভরিয়ে তোলে তার কোমল জমিন। কোথাও ফেরার ভীষণ তাড়া অস্থির করে তোলে আমাকে। কোনো এক নরম শাড়ির কোমল ভাঁজে লুকিয়ে রাখা স্নেহফুলের ঘ্রাণ পেতে পিপাসায় ফেটে যায় বুক। অজান্তেই উঠে দাঁড়াই। স্টেশনের উল্টোদিকের রেলপথ ঘেঁষে ছড়িয়ে থাকা রেলওয়ের জমির দিকে হাঁটি। রেললাইনের সমান্তরালে ছড়িয়ে থাকা এসব ফাঁকা জমিতে ভূমিহীন পরিবার ঘর তোলে, যাপন করে নির্ঝঞ্ঝাট দিন। তেমনি এক পরিবার চোখে পড়ে। এক নারী। উবু হয়ে বসে কিছু একটা কাজে ব্যস্ত। আমার দিকে পেছন ফেরা। একটা ছোট্ট খুপড়ি। পলিথিনে ছাওয়া। কোনোমতে হামাগুড়ি দিয়ে ঢোকা যায় তাতে। দুটো শিশু পা ছড়িয়ে বসে খেলছে, কিচিরমিচির কথা বলছে নিজেদের ভেতর। একটা মাটির চুলা। পাশে কিছু লাকড়ি জড়ো করে রাখা। দুয়েকটা জীর্ণ বাসন ছড়িয়ে আছে ইতস্তত। অদূরে একটা বিশাল শিমুল গাছ। তার সঙ্গে শেকল দিয়ে আটকে রাখা একটি কাঁচা সবুজ রঙের স্টিলের সিন্দুক। বড় একটা লোহার তালা ঝুলছে তাতে। এই নিয়ে এই নারীর ইহজাগতিক বোঝাপড়া। মায়ার অদৃশ্য শেকল। আমার মন এমন এক শেকলের জন্য হাহাকার করে। আমার স্মৃতিভ্রষ্ট মন সেই শেকলে বাঁধা পড়তে অস্থির হয়ে ওঠে।
এই শহর, এই কোলাহল, এই গতিময়তা অর্থহীন লাগে আমার। আমার কেবলই মনে হয় কোথাও এমন কোনো মায়ার শেকল আমাকে বাঁধবে বলে ডাকছে, আমাকে তার স্নেহের অধরে আঁকবে বলে টানছে। বিত্তহীন, প্রান্তিক ঐ নারীকে হঠাৎই ভীষণ ঈর্ষা হয় আমার। ঈর্ষা হয় উলঙ্গ ঐ শিশুদুটোকেও। ওরা ভাগ্যবান। স্নেহের আঁচল আগলে আছে ওদের। আমি কে? কেউ নই। অচেনা এক আগন্তুক। কোনো গন্তব্য নেই। নেই কোনো ঠিকানা। আমি সামনে এগোই। রেললাইন ছাড়িয়ে পাকা রাস্তায় উঠি। শহরের কোলাহল আবার গ্রাস করে আমাকে। অনেক মানুষ। জনস্রোত। একটা মানুষকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নিয়ে যায় কয়েকজন। পুলিশ। লোকটার অপরাধ কী? প্রশ্নটা মনের মধ্যে লাফিয়ে উঠেই হারিয়ে যায় আবার। হ্যান্ডকাফ পরা লোকটাকেও হিংসে হয় আমার। লোকটার পাশে তার স্বজনেরা হাঁটে, পুলিশের কাছে লোকটাকে ছেড়ে দেয়ার করুণ প্রার্থনা জানায়। দেখে ঈর্ষায় জ্বলে যায় বুক। এই বিশ্বচরাচরে সবার স্বজন আছে, ঠিকানা আছে, গন্তব্য আছে, স্মৃতি আছে। আমার কিছুই নেই। কিংবা সব ছিল, আছে, শুধু স্মৃতিটুকু নেই। আমাকে কেউ চেনে না এখানে, কাউকে চিনি না আমিও। আমি উদ্দেশ্যহীন হাঁটি। ভীড় সরিয়ে, কোলাহল পাশ কাটিয়ে হাঁটতে থাকি গন্তব্যহীন। মিছিলটা সামনে চলে আসে আবার। আবার আমার মাথার মধ্যে আছড়ে পড়ে স্লোগান। করোটিতে আঘাত করে ভীষণ জোরে। আমি অজান্তেই মিছিলে ঢুকে যাই। স্লোগানে উত্তাল মিছিলের অগ্রভাগে চলে যাই। তীব্র গর্জনে ঝলসে উঠি, ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’…
হঠাৎ গুলির শব্দ হয়। ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মিছিল। কারা যেন চিৎকার করে। দৌড়ায়। হুটোপুটি করে। কয়েকটা বুলেট আমার বুকে এসে গেঁথে যায় আমূল। হঠাৎ নিজেকে খেয়াল করি। আমার বুকে লেখা ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ পিঠে, ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’! কেন? কে লিখেছে? কখন? মনে পড়ে না। শুধু বুক আর পিঠ বেয়ে গড়িয়ে পড়া উষ্ণ লাল কৃষ্ণচূড়াগুলোকে ভীষণ চেনা লাগে আমার। ভীষণ পরিচিত। মিছিল ছড়িয়ে পড়ে শহরময়। বুকে, পিঠে, লাল লাল উষ্ণ কৃষ্ণচূড়া নিয়ে আমি হেঁটে যাই মিছিলে মিছিলে। মিশে যাই জনারণ্যে।
আরও পড়ুন- অনামিকা হক লিলি’র গল্প- আক্রোশ