Mostafizur Rahman is a professional content writer at CrawlText, specializing in SEO articles, blog posts, and web copy that drive engagement and conversions. With experience crafting clear, audience-focused content for almost all the niches, he delivers well-researched, optimized pieces on deadline. He combines editorial rigor with keyword strategy to boost traffic, authority, and reader retention across blogs, platforms, and newsletters.
শহীদুল জহিরের গল্প
আগারগাঁও কলোনিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই
আবদুস সাত্তার বাসায় ফিরছিল; তালতলায় বাস থেকে নেমে বিকেলের নরম আলোয় পায়ে হেঁটে যখন তার কলোনির বাসার দিকে আসছিল তখন কেউ কেউ তাকে দেখেছিল, যদিও শীর্ণ এবং কালো রঙের একজন মধ্যবয়স্ক কেরানির অফিস শেষে গৃহে প্রত্যাবর্তনের এই নিত্যদিনের ঘটনা তাকিয়ে দেখার মতো কিছু ছিল না। সে যখন কলোনির ভেতরের রাস্তায় প্রবেশ করে তখন, সেটা হয়তো বর্ষার মৌসুম ছিল বলে অথবা অদিনের কোনো বর্ষণের কারণে, সেই ইট বিছানো ভাঙাচোরা রাস্তার অসংখ্য গর্ত পানিতে পূর্ণ হয়ে ছিল এবং যেখানে গর্ত ছিল না সেখানে রাস্তা পিচ্ছিল এবং কর্দমাক্ত প্রতারক পিঠ উঁচু এবং বাঁকা করে রেখেছিল। হাঁটুর নিচে প্যান্টের প্রান্ত টেনে তুলে বকের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে পথ অতিক্রম করার সময় নিজের বিল্ডিংয়ের সামনে এসে রাস্তার এরকম একটি পিচ্ছিল অংশের ওপর আবদুস সাত্তারের পদস্খলন ঘটে, পিছন দিকে দুহাত প্রসারিত করে দিয়ে সে কাদাপানির ওপর বসে পড়ে। সেই সময় এই দৃশ্য যারা দেখে তারা হেসে ওঠে, তারপর দ্রুত এগিয়ে এসে তাকে ধরে কাদা থেকে ওঠায়; তখন ঘটনাটির বিবেচনায় আবদুস সাত্তারের নিজের ওষ্ঠও খানিকটা স্ফুরিত হয় এবং সে বলে, পইড়া গেলাম; এবং এভাবে কেবলমাত্র পা পিছলে পড়ে যাওয়ার কারণে বহু দিন পর তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে তার একটা কিছু বলার সুযোগ হয়।
ঘরে ফিরে সে তার স্ত্রী শিরীন বানুকেও এই একটি কথাই বলতে পারে, পইড়া গেলাম কেদোর মইধ্যে; তারপর রোজদিনকার মতো শেষ বিকেলের ধূসর আলোয় সে ব্যালকোনির বারান্দায় গিয়ে বসে। ব্যালকোনির বেতের চেয়ারে শরীর ডুবিয়ে সে রাত পর্যন্ত বসে থাকে, বাসার ভেতর তার দু পুত্র ও এক কন্যা এবং স্ত্রী লেখাপড়া করে, কলরব করে, পাশের ফ্ল্যাটে গিয়ে টেলিভিশন দেখে, আর সে তখন বারান্দায় অন্ধকারের সঙ্গে মিশে থাকে। সে দেখে দিনের আলো মুছে যাওয়ার পর অন্ধকার কেমন গভীর আর স্পর্শযোগ্য হয়ে ওঠে; সে তাকিয়ে থাকে শুধু, এতে তার কোনো আনন্দ অথবা ক্লান্তি হয় না, যেমন, কেরানির সরকারি চাকরিতে সে ক্লান্তির-বোধহীনভাবে লেগে থাকে। এভাবে বসে থাকার সময় কখনো যখন দক্ষিণা বাতাস বয়ে আসে তখন কলোনির বাসার এই সংকীর্ণ বারান্দার টবে তার স্ত্রীর লাগানো সবুজ গাছেরা সরসর শব্দ করে দুলতে থাকে এবং রেলিংয়ের ওপর দড়ি দিয়ে বাঁধা, পটের মাটিতে জন্মানো নয়নতারা ফুলের অস্পষ্ট সোঁদা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। আবদুস সাত্তার সেই ধ্বনি এবং গন্ধের ভেতর বেতের চেয়ারে আবহমান কাল ধরে বসে থাকে, এবং তার স্ত্রী শিরীন বানু কলোনির বাসাটির সর্বত্র টবে লাগানো রকমারি গাছে ভরে তোলে; বারান্দায় নয়নতারা এবং পাতাবাহার গাছের সঙ্গে সে রজনীগন্ধার চারা লাগায়।
আবদুস সাত্তার এসব কিছু দেখে অথবা দেখে না, সে এসব নিয়ে কিছু বলে না; তার বাসার ভেতরটায় পত্র-পল্লবের যে একটি সবুজ জগৎ গড়ে ওঠে, তার প্রতি তার কোনো খেয়াল আছে কি না, এটা তার মৃত্যুর দিনের আগ পর্যন্ত অপ্রকাশিত থাকে । শিরীন বানুর প্রশ্রয়ে তাদের বাসার প্রতিটি দরজায় ঢলো ঢলো পাতাবাহারের বিস্তার ঘটে; আলমারি, বইয়ের তাক আর খাটের মশারি স্ট্যান্ডের ওপর থেকে ঝুলে থাকে সবুজ সাপের মতো মানিপ্ল্যান্টের শাখা । রাতে খাবার খাওয়ার পর আবদুস সাত্তার যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন তার খাটের শিথানের দিকে ড্রেসিং টেবিলের পাশে স্থাপিত ঝাঁকড়া একটি গাছ প্রতিদিন দুলে দুলে শ্বাস টানে; আবদুস সাত্তার দেখে না, সে ঘুমিয়ে থাকে; কিন্তু তার প্রতিবেশীরা দেখে, তারা তার স্ত্রীর অফুরন্ত প্রশংসা করে, কলোনির মহিলারা ঘরের ভেতর অরণ্যের এই সমাবেশ দেখে উত্তেজনায় আত্মহারা হয়ে পড়ে। আবদুস সাত্তার এবং তার পরিবার এই কলোনিতে চার বছর আগে আসার পর থেকে তার স্ত্রী এই চার বছর যাবৎ টবে গাছ জন্মানোর শিল্পচর্চার চরম বিকাশ ঘটায় এবং এই গাছ তাদের গৃহের সীমানা অতিক্রম করে প্রতিবেশীদের গৃহে ছড়িয়ে পড়ে। কলোনির এই ভবনটির সকল অধিবাসী—বিভিন্ন সরকারি অফিসের কেরানি, ইন্সপেক্টর এবং পাতি কর্মকর্তাবৃন্দের স্ত্রীরা তাদের বাসার ভিতরটা গাছে পূর্ণ করে ফেলার প্রতিযোগিতায় নেমে যায়।
শহীদুল জহিরের গল্প
এতে করে বাহ্যত প্রকৃতির সঙ্গে আধুনিক মানুষের সম্পর্কের যে ভারসাম্য ছিন্ন হয়েছে বলে জ্ঞানীজনেরা মনে করে, তা এই ভবনটির ভেতর যেন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এমনকি মানুষের সঙ্গে কলোনির এই ভবনের অধিবাসী মানুষদের সম্পর্কের যে নৈতিক বিচ্যুতি ঘটে, তাও যেন কতিপয় গুল্মজাতীয় গাছের সবুজ পত্র-পল্লবকে ঘিরে মেরামত হয়ে ওঠে। কলোনির এই সকল রমণী এবং তাদের পুরুষেরা জীবনের সৌন্দর্যকে শেষ পর্যন্ত আবিষ্কার করতে শেখে, অর্থহীন এবং বিচ্ছিন্ন জীবনযাপনের বৃক্ষময় অর্থময়তা খুঁজে নেয় এবং এজন্য তারা সকলে আবদুস সাত্তারের স্ত্রী শিরীন বানুর নিকট কৃতজ্ঞতা মানে। কেবল আবদুস সাত্তার এই বৃত্তের বাইরে থেকে যায়, ঘরের ভেতর লাগানো নধর ক্যাকটাসের দিকে তাকিয়ে তার কিছু মনে হয় না; যখন হঠাৎ কিছু মনে হয়, তখন তার এরকম মনে হয় যে, এই গাছটি মানুষের জীবনের মতো -শ্রীছাঁদ, মাপজোখহীন এবং সর্বাঙ্গ কণ্টকাকীর্ণ। আবদুস সাত্তার কলোনির যে বিল্ডিংয়ে থাকে তার প্রতিটি ব্যালকোনি থেকে সবুজ লতা ঝুলে নিচের দিকে নেমে আসে এবং ব্যালকোনির রেলিংয়ের ওপর লাগানো নয়নতারা ফুলে হলুদ রঙের এই ভবনের সামনের দিকে লালচে বেগুনি রঙের এক নকশা রচিত হয়।
বিকেল হলে যখন রোদ ফিকে হয়ে আসে, তখন আগারগাঁওয়ের পাশের বিমানবন্দরের ঝোপঝাড় ত্যাগ করে প্রজাপতিরা কলোনির এই ভবনের সামনে এসে নাচ শুরু করে, এবং এই কলোনিতে প্রজাপতিদের উঠে এসে এভাবে ঘুরে ঘুরে নেচে যাওয়া বহুদিন ধরে হতে থাকে । প্রথম যেদিন প্রজাপতিরা উঠে আসে, সেদিন কলোনির লোকেরা ভয় পেয়ে যায় এই ভেবে যে, প্রজাপতিরা তাদের গৃহেই হয়তো থেকে যাবে, এবং ডিম পেড়ে তাদের সবুজ স্বপ্নের ভেতর সোনালি শুঁয়োপোকার রাজত্ব গড়ে তুলবে। কিন্তু তাদের ভয় সহসাই অপনোদিত হয়, প্রজাপতিরা মানুষের ঘরে থাকে না; বিকেলের আলো মরে যেতে থাকলে তারা চতুর্দিকে মিলিয়ে যায়। এই প্রক্রিয়া কলোনির এই ভবনটির সম্মুখে এক বৎসর যাবৎ চলে এবং এর ভেতর আবদুস সাত্তার একটি অজর এবং অবশ্যম্ভাবী প্রস্তরখণ্ডের মতো নিশ্চল অস্তিত্ব নিয়ে জেগে থাকে; প্রজাপতিরা বারান্দায় উঠে এসে যখন দুলে দুলে উড়তে থাকে তাদের পাখার ঝাপটা লেগে আবদুস সাত্তারের মুখে, চিবুকে, কানের পিঠে হলুদ রেণু জমা হয়। সে তাকিয়ে দেখে, হাত দিয়ে কানের গহ্বর থেকে প্রজাপতির পাখার রেণু সাফ করে, জামার ভিতর প্রজাপতি ঢুকে গেলে ছাড়িয়ে দেয়, মনে হয় যেন এইসব পতঙ্গের অধিকারের ভেতর বসবাসে সে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, মনে হয় যেন তার অসুবিধা হয় না এখন, যদিও এক বছর পূর্বে যখন প্রজাপতিরা প্রথম কলোনির নয়নতারা ফুলের রূপে আবিষ্ট হয়ে আসতে শুরু করে, তখন এ নিয়ে এই শহরে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়, তাতে আবদুস সাত্তারের জীবনের নিস্তরঙ্গতায় বিঘ্ন ঘটে। প্রজাপতিদের চঞ্চল হয়ে ওঠার খবর মুখে মুখে প্রচারিত হলে শহরের ক্লান্ত, বিমর্ষ এবং ঝিমিয়ে পড়া মানুষের ভেতর উত্তেজনা তৈরি হয় এবং একদিন একটি দৈনিক পত্রিকার শেষ পাতায় এ সম্পর্কে সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হলে অবস্থাটা চূড়ান্ত রূপ নেয় ।
প্রতিদিন বিকেলবেলা প্রজাপতিরা উঠে আসার আগ থেকেই শহরের বিনোদনবঞ্চিত এইসব বিবর্ণ মানুষে ছয়তলা এই কলোনি ভবনের সামনের রাস্তা ভরে ওঠে এবং শূন্যে চলমান গাঁদা ফুলের বাগানের মতো হলুদ প্রজাপতিরা যখন ঝাঁক বেঁধে এসে নয়নতারা ফুলের চারিদিকে নাচতে থাকে, তখন এই মানুষেরা নির্বাক বিস্ময়ে দেখে; এবং তখন তাদের মনে হতে থাকে যে, মানুষের নয়, রূপবান প্রজাপতিরই সার্থক জীবন। এই লোকেরা একটি বারান্দার রেলিংয়ের ফোকর দিয়ে আগাগোড়া যে একটি মাঝবয়সী লোককে প্রজাপতিদের ভিড়ের ভেতর বসে থাকতে দেখে, সে হচ্ছে আবদুস সাত্তার । এইসব মানুষের আনাগোনায় সে প্রথম নির্লিপ্ত থাকার চেষ্টা করলেও তাকে ক্রমাগতভাবে তার পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে সচেতন হতে হয়; কারণ প্রজাপতি দেখতে আসা মানুষের বিস্ময় খুব শীঘ্রই কেটে যেতে থাকে এবং প্রজাপতির জীবনের সার্থকতা সম্পর্কিত তাদের পূর্বসিদ্ধান্ত বদলায়, ফলে তারা পুনরায় একঘেয়েমির ক্লান্তিতে আক্রান্ত হয়। এই বিরক্তি দূর করার জন্য তাদের কেউ কেউ প্রজাপতিদের লক্ষ করে মাটির ঢেলা ছুড়ে মারতে শুরু করে; ছুড়ে মারা এইসব মাটির দলা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে কলোনির ভেতর বারান্দায় এসে পড়ে এবং এরকম একটি ঢেলা একদিন বারান্দায় বসে থাকা আবদুস সাত্তারের গায়ে এসে লাগে । এই অবস্থার ভেতর সহসাই চিনেবাদাম আর আইসক্রিমওয়ালারা বিরক্ত মানুষের বিনোদনের জন্য এসে হাজির হয়, তাদের চিৎকার এবং ঘণ্টাধ্বনিতে চারদিক মুখরিত হয়ে ওঠে।
শহীদুল জহিরের গল্প
নগর রক্ষকেরাও এ সময় তৎপর হয়, শান্তি-শৃঙ্খলার বিষয়টি যাতে বিঘ্নিত হয়ে না পড়ে সে জন্য ভবনটির সামনের মাঠের এক কোণায় অস্থায়ী পুলিশ পাহারা বসানো হয় এবং তখন একদিন বন বিভাগের লোকেরা আসে, তারা কলোনির সম্মুখের রাস্তার একধারে বাঁশের খুঁটি পুঁতে একটি সাইনবোর্ড টাঙায়, তাতে লেখা হয় যে, এই প্রজাপতি দেখার জন্য, এগুলো ধরা কিংবা এর কোনো ক্ষতি করা যাবে না; কেউ তা করলে, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে সে দণ্ডিত হবে। কলোনির অবস্থা যখন মেলার মতো ধুলো আর কোলাহলপূর্ণ বিভ্রান্তিতে রূপ নেয় এবং আবদুস সাত্তার যখন প্রথমবারের মতো ভাবে যে, তার জীবনের এই পরম আশ্রয়ের স্থানটিতে হয়তো তার পক্ষে আর বসা সম্ভবপর হবে না, তখন একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কলোনির লোকেরা রেডিওতে শুনতে পায় যে, আগের দিন রাতে দেশের সরকার বদল হয়ে গেছে; এবং এর ফলে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়, যাতে করে আবদুস সাত্তার রক্ষা পায়, তাকে তার বারান্দা ছাড়তে হয় না। জেনারেলদের এই নতুন সরকার দেশ ও মানুষের জন্য দ্রুত এবং গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদক্ষেপ নেয়, তার ভেতর থাকে মিরপুর চিড়িয়াখানা আধুনিকায়নের কাজ। জরুরি ভিত্তিতে কেনিয়া থেকে এক ডজন শিম্পাঞ্জি আমদানি করা হয় এবং পুরনো বানরদের খাঁচার পাশে নতুন খাঁচায় এদের প্রদর্শনী বসানো হয়।
পত্রিকায় এই শিম্পাঞ্জিদের ছবি এবং খবর ছাপা হলে শহরের একঘেয়েমির ক্লান্তিতে বিরক্ত মানুষ নাড়া খেয়ে ওঠে, তারা শিম্পাঞ্জি দেখার জন্য মিরপুরের দিকে ধাবিত হয়, তখন আগারগাঁও কলোনির মাঠ পুনরায় নীরব হয়ে আসে; এই নীরবতার ভেতর আবদুস সাত্তার ছোট ছোট শ্বাস ফেলে পুনরায় ডুবে যেতে পারে। কিন্তু জগতে অধিকাংশ মানুষ সর্বদাই চঞ্চল; মানুষ খেয়াল করে না যে, তার চাঞ্চল্য সংক্রমিত হয় একটি পুকুরে নিক্ষিপ্ত ইটের সৃষ্ট ঢেউয়ের মতো; এবং এ সময় একদিন এ রকম কোনো এক চাঞ্চল্য কোনো এক উৎসে সৃজিত হয়ে প্রবাহিত হয় এবং তা অন্ধকারে উড়ে এসে ব্যালকোনিতে বসা আবদুস সাত্তারের শরীরের ওপর পড়ে। সে এই আপতিত বস্তু কুড়িয়ে নিয়ে শুঁকে দেখার আগেই বুঝতে পারে যে, এটি একটি ফুল; এবং নাকের কাছে এনে সে নিশ্চিত হয় যে, এটা গোলাপ; সে গোলাপটা রেখে দেয়। পরের দিনের গোলাপটা তার চেয়ারের কাছ থেকে এক হাত দূরে পড়ে, তারপর পাঁচ দিন কোনো ফুল পড়ে না, ষষ্ঠদিন পড়ে পরপর দুটো; এভাবে অন্ধকার ফুঁড়ে আবদুস সাত্তারের ব্যালকোনিতে গোলাপ ফুল উড়ে আসতে থাকে । আবদুস সাত্তার ফুলগুলো গ্রহণ করে, গন্ধ নেয়; কিন্তু বেশি কিছু ভাবে না ।
তারপর একদিন সে যখন স্বাভাবিক সময়ের আগে ভেতরে রাতের খাবার খেতে যায়, তখন তার স্ত্রী ঠাণ্ডা বাতাসের জন্য ব্যালকোনিতে এসে দাঁড়ায় এবং তখন সেদিনের গোলাপ ফুলটি উড়ে আসে । শিরীন বানু যখন দেখে , বাইরের অন্ধকারের ভেতর থেকে উড়ে এসেছে একটি ফুল, সে বিচলিত হয়, কিন্তু এই রহস্যের কিনারা সে করতে পারে না; গোলাপটি হাতে করে বসে থাকে । খাবার খাওয়ার পর আবদুস সাত্তার যখন ব্যালকোনিতে আসে, শিরীন বানু অন্ধকারে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, নাও ।
শিরীন বানু কথা বলে না, আবদুস সাত্তার গ্রহণ করে বুঝতে পারে, গোলাপ । তোমাকে কে গোলাপ ছুড়ে দেয়?
কি?
আবদুস সাত্তারের তখন, এই প্রথম মনে হয় যে, এটা একটা রহস্য বটে, কিন্তু এ বিষয়ে তার অনুসন্ধান আর বেশি দূর যায় না।
জানি না ।
এ জন্যই তুমি বারান্দায় বসে থাক?
তারা দুজন দুজনের মুখ দেখতে পায় না, আবদুস সাত্তার বলে, না ।
বলতে লজ্জা পাও?
লজ্জা কিসের?
তাহলে?
কি তাহলে?
গত এক মাস যাবৎ আমি বারান্দা থেকে ছেঁড়া শুকনা ফুল পরিষ্কার করছি। তাতে কি হয়েছে?
শহীদুল জহিরের গল্প
শিরিন বানু তখন অনুচ্চ চাপা স্বরে কী যেন বলে, আবদুস সাত্তার ভালোমতো শুনতে পায় না, কিন্তু হঠাৎ তখন তার বহুদিন পূর্বে বাইরের অন্ধকারের ভেতর থেকে উড়ে আসা একটি নীল মাছির কথা মনে পড়ে এবং সে বলে, উনিশ শ সত্তর সনের ১৮ মার্চ
তারিখটা কি তোমার মনে আছে?
শিরীন বানুর স্মৃতিতে সময়ের অর্থহীন ঢেউ ক্রমাগত ভাঙে, তার কিছু মনে পড়ে
না; সে বলে, কি হয়েছিল সে দিন?
এটা আমাদের বিয়ের তিন মাস পরের একটা দিন, আবদুস সাত্তার বলে, বিয়ের পর এই দ্বিতীয়বারের মতো তুমি ঢাকা আসছিলে । তোমাকে নিয়ে আসার জন্য আমি সিরাজগঞ্জে গেছি, সত্তর সনের ১৮ মার্চের সন্ধ্যায় ট্রেন ধরব আমরা; তুমি তৈরি হয়েছ, বাক্স-পেটরা গোছানো হয়েছে, কালীবাড়ি রোডে তোমাদের বাড়ির ফটকের সামনে টমটম দাঁড়ানো । সব তৈরি, সবাই বারান্দায় এবং প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে, তুমি ঘরের ভেতর, এখনই বেরুবে। আমি তখন ঘরের পেছনে অন্ধকারে তোমাদের কাঁচামিঠে আম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে প্যান্টের চেইন টেনে পেশাব করছি; ঘরের পেছনের জানালার একটা কপাট খোলা ছিল, আমি তোমাকে দেখলাম। তশতরির ওপর তখনো মধু লাগানো বিস্কুট ছিল, তুমি একটা তুলে নিয়ে খেলে; তোমার ঠোঁটে মধু লেগে গেল, এবং তখন বাইরের অন্ধকারের ভেতর থেকে একটি নীল বড় মাছি উড়ে এল ঘরে, এসে বসল তোমার ঠোটে, দ্রুত। তুমি মাছিটিকে সরিয়ে দিয়ে ঠোঁট মুছে বেরিয়ে গেলে, আমি তখন আম গাছের নিচে পেশাব করছি; তোমার কি মনে পড়ে?
অন্ধকার এবং নীরবতা ছাড়া তাদের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না । তখন অনেকক্ষণ পর আবদুস সাত্তার পুনরায় জিজ্ঞেস করে, তোমার কি মনে পড়ছে না? আমি জানি সেই পায়খানা থেকে; তোমার কি মনে পড়ে না? নীল মাছিটা এসেছিল ঘরের পেছনে বেত গাছের ঝোপের ভেতরে তোমাদের কাঁচা
না, মনে পড়ে না; শিরীন বানু বলে, আমি এক পাগলের ঘর করি ।
এরপর থেকে সন্ধ্যার অন্ধকারে আবদুস সাত্তার গোলাপ ফুল গ্রহণ করে যায় এবং শিরীন বানু পরদিন সকালে ব্যালকোনি থেকে শুকিয়ে আসা গোলাপের শব অপসারণ করে; উড়ে আসা গোলাপ ফুলের রহস্যের তারা সমাধান করতে পারে না। তবে মনে হয় যেন একদিন এর খুব সহজ একটি উত্তর আবিস্কৃত হয়; একদিন আবদুস সাত্তারের বাসার নিচের দোতলার ফজলুল করিম তার স্ত্রী, দু মেয়ে এবং এক কিশোর পুত্রকে নিয়ে কলোনির বাসা ত্যাগ করে গেলে, ঠিক মাথার ওপরে পাঁচ তলায় রহিমউদ্দিন ভূঁইয়ার কিশোরী কন্যাটির চাপা কান্নার শব্দ শোনা যায় । সেদিন রাতে কোনো ফুল পড়ে না এবং এরপর বর্ষার বারিপাত যেমন করে থেমে যায় তেমনি করে আবদুস সাত্তারের বারান্দায় শুনেছি, একটু পাগলাটে ছিল এবং ভূমিকম্পের সময় নয়নতারা গাছের দুটো টব বাঁচাতে গিয়ে নিজেও পড়ে যায়; তাহলে কি ব্যাপারটা এইসব গাছের ব্যক্তিগত কোনো বিষয় ? হতে পারে।
অন্তত এই কলোনির নয়নতারা গাছগুলোকে একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে সরিয়ে নিলে তারা যে মরে যায়, সে বিষয়ে আমার ধারণা হচ্ছে এই যে, গাছগুলো স্রেফ আত্মহত্যা করে। কারণ, তাদের মরে যাওয়ার কোনো বাস্তব কারণ আমি খুঁজে পাইনি। এই নয়নতারা গাছগুলো কেন মরে যায়, সে সম্পর্কে এ ছাড়া অন্য কিছু আমি বলতে পারি না। আমি তো জানি, গাছেরা কেমন সংবেদনশীল প্রাণী। আর এ ক্ষেত্রে আত্মহত্যার এই ইচ্ছে প্রথমে এক গাছ থেকে অন্য গাছে ছড়ায় গাছগুলোর নৈকট্যের কারণে এবং প্রজাপতি সম্ভবত এই প্রক্রিয়ায় মেসেঞ্জারের কাজ করেছে; পরে, আমার সন্দেহ হয়, মাটিরও কোনো এক ধরনের ভূমিকা থাকতে পারে। প্রজাপতির সংস্পর্শ এড়াতে পারলে এবং অন্যখান থেকে মাটি এনে গাছ লাগালে, আগারগাঁও কলোনিতে নয়নতারা ফুল গাছ হয়তো আবার হবে। আমি পলিথিনের ব্যাগের ভেতর একটি চারাকে এভাবে বাঁচাতে পেরেছিলাম। তবে, এভাবে এক্সপেরিমেন্ট করা যায়, বাগান করা যায় না । আমার এই অনুচ্ছেদটি একজন বিজ্ঞানীর লেখা হিসেবে হয়তো উৎকৃষ্ট হলো না; তবে আমি যা দেখেছি এবং ভেবেছি, তা লিখে রাখায় দোষ দেখি না ।
কৃষি কলেজের অধ্যাপকের রোপণ করা চারটি নয়নতারা গাছ আগারগাঁও কলোনির সামনে, ভূমিতে ছিল (পলিথিন ব্যাগের ভেতর পটে জন্মানো চারাটি তিনি ফেলে দিয়েছিলেন)। কিন্তু পরবর্তীকালে কোনো এক সময় গণপূর্ত বিভাগের লোকেরা এসে দালানের সম্মুখ দিয়ে পিচ ঢালা একটি রাস্তা বানায় এবং রাস্তা ও দালানের মাঝখানের জায়গাটুকুতে যাতে জঞ্জাল না জন্মায়, সেজন্য তা পাকা করে দেয়। তখন তারা শেষ চারটি নয়নতারা গাছ তুলে সাফ করে ফেলে এবং তারপর থেকে এই কলোনিতে নয়নতারা ফুল গাছ নেই। তবে, কৃষি কলেজের অধ্যাপকের পরামর্শমতো প্রজাপতি ও মাটির বিষয়ে সাবধান থেকে চেষ্টা করলে ভবিষ্যতে হয়তো এখানে পুনরায় নয়নতারা ফুল দেখা যাবে।
আরও পড়ুন- হাসান আজিজুল হকের গল্প

Mostafizur Rahman is a professional content writer at CrawlText, specializing in SEO articles, blog posts, and web copy that drive engagement and conversions. With experience crafting clear, audience-focused content for almost all the niches, he delivers well-researched, optimized pieces on deadline. He combines editorial rigor with keyword strategy to boost traffic, authority, and reader retention across blogs, platforms, and newsletters.
