প্রচ্ছদসাহিত্য

প্রতারণা: রফিকুজ্জামান রণি’র গল্প

দ্রুত খোলস বদলে ফেলে সময়। একদিন সকল মুখোশ অবারিত হয়। তারপরও বলতে হয়, মানুষ জানে হাজার রকম বায়না, সব চেনা যায় মানুষ চেনা যায় না।

দূর থেকে রেললাইনের দুটি লোহার পাতের দিকে তাকালে চোখেরও ভ্রম হয়। মনে হয়, পরস্পর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। একটি লাইন আরেকটি লাইনকে আগলে ধরে মনের আনন্দে কোলাকুলি করছে। কিন্তু একটু এগোলেই কেটে যায় সব ঘোর, চোখে পড়ে দুটি আলাদা সংসার। দূরত্বের রহস্য গোপন থাকে না আর।

আলেয়া জীবনে বহুবার সাপের খোলস দেখেছে। তবে সেগুলো কোন কোন প্রজাতির সাপের সেটা বোঝার সাধ্য ছিলো না তার। কিন্তু মানুষেরও যে খোসল থাকে আজই প্রথম টের পেলো সে। ততক্ষণে সে অসহায়, পাষুণ্ড হাতের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে।

যার ভরসায় বিনোদনপুরের মাটি মাড়িয়েছে সেই দুলুর অদ্ভুত চেহারা দেখে সে হতবাক। দীর্ঘদিন সম্পর্ক থাকার পরও তার আসল চেহারা ধরতে পারেনি আলেয়া। পারলে এই সর্বনাশ হতো না। চিনবে কেমন করে, ভার্চুয়াল জীবন যে প্রতিটি মানুষের মুখে মুখে মুখোশ লাগিয়ে রেখেছে আজকাল।

আগেও অনেকবার বিনোদনপুরে আসার নিমন্ত্রণ পেয়েছিল সে। সমাজের জটিল সীমাবদ্ধতা তাকে আসতে দেয়নি। জীবনের এক অনিবার্য বাঁক-পরিক্রমা এবং দুলুকে দেয়া প্রতিশ্রুতিটুকু তাকে আজ টেনে এনেছে। সম্পর্কের চোরাটানের কারণে, পৃথিবীর কোনো পাঁচিল তাকে আটকে রাখতে পারেনি।

ঘরথেকে বেরোনোর সময় দুলুর সঙ্গে ফোনালাপ হয়েছে। মুখোমুখি হওয়ার বিস্তারিত বাতলে দেয়া হয়েছে তখন। সে সময়ও তাকে বেশ বিশ্বস্ত মনে হয়েছিলো। ধূপছায়ার মতো সন্ধের আবরণ গাঢ় হতে না হতেই সকল বিশ্বাস হাওয়াই মিলিয়ে গেল।

সবকিছুই ঠিকঠাক মতো চলছিলো। যখন তারা মুখোমুখি হয় তখন আলেয়া একা, দুলুর সঙ্গে পাঁচ-ছজন বন্ধু। এটা ব্যাপার না। বন্ধুরাই তাদের নিরাপত্তার সব ধরনের ব্যবস্থা করবে। দুলু তাকে বশ করতে খুব একটা সময় লাগেনি।

‘কাজী অফিস অনেক দূরে। ফিরতে অনেক রাত হবে। গাড়ি পাওয়া যাবে না। আজ লাবণ্যের বাড়িতে তোমাকে নিয়ে উঠবো। ও আমার বন্ধু। বাড়ির সবাই বেড়াতে গেছে। সে শুধু বাড়িতে আছে। আমরা খুব ভোরে উঠেই কাজী অফিসের দিকে রওনা দেবো।’ এ ধরনের কথা বলে মেয়েটিকে ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে বাড়িতে নিয়ে উঠলো।

অনেক পুরাতন একটি বাড়ি। বিরাট বাড়িতে পিনপতনের শব্দ নেই। এ রকম নিরাপদ স্থান আর কোথা জুটবে? আলেয়া অনেকটা সংকোচ করতে করতে বাড়িতে প্রবেশ করলো। ঢোকার পরপরই ঋতুচক্রের মতো বদলাতে লাগলো হাওয়া। কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই হামলে পড়লো এক দল মানুষরূপী কুকুর।

রাতভর যুবকদের পাশবিক অত্যাচারে প্রায় সংজ্ঞাহীন সে। তার কোনো আকুতি মঞ্জুর করেনি তারা। উল্টো পরম উল্লাসে কুৎসিত দৃশ্যগুলো ফোনে ভিডিও করে নিলো। প্রথমেই গহনা-ঘাটি, মোবাইল সেট ও নগদ টাকাপয়সাগুলো ছিনিয়ে নিলো। তারপর…। ফলে এক অদ্ভুত শূন্যতায় নিমজ্জিত হলো সে। আলেয়া অজ্ঞানপ্রায়।

কী নিখুঁত পরিকল্পনা! শেষরাতে টিয়া-রঙের একটা গাড়ি বাড়ির সামনে এসে থামলো। অন্ধকার সাঁতরিয়ে আলেয়াকে তোলা হলো সেখানে। তখনও সে গোঙাচ্ছে। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। অথচ জানোয়ারগুলো তার নিতম্বের দিকে ইঙ্গিত করে করে নোংরা হাসি হাসছে। গোপনস্থানে খোঁচা মেরে মেরে হৈহুল্লোড়ে মেতে উঠেছে। অন্ধকার সাঁতরিয়ে তীক্ষè আলো জ্বালিয়ে এগিয়ে চলছে গাড়ি। কোথায় গন্তব্য, কেউ জানে না।

কিছুকাল পর একজন বললো, মালটাকে এখানেই রেখে যাওয়া নিরাপদ। বেশিদূর গেলে ধরা পড়ে যাবো। অন্ধকার কাটতে শুরু করেছে কিন্তু…।

কথা মতো গাড়ি থামানো হলো। আলেয়াকে একটা রেলরাস্তার উপরে ছুড়ে ফেলা হলো। এরপর তারা চোখ রাঙিয়ে বললো-‘যা হয়েছে ভুলে যা, বেঁচে যাবি। এই কথা যদি কারো কাছে বলিস্, তাহলে মোবাইলের ভিডিওগুলো তোর বাপ-মার কাছে পাঠামু, ইন্টারনেটে ভাইরাল করুম। কথাডা মনে থাকে যেন।’

একজন পকেট হাতড়ে কিছু টাকা বের করে বলল-‘এই নে টাকা। এই টাকা দিয়ে মন যেখানে চায় চলে যাবি। আমাদের ব্যাপারে তুই কিছুই জানিস না। এই কথাটা মনে থাকে যেন। যদি পারিস ট্রেনের নিচে গিয়ে মাথা দিস্, বেঁচে যাবি।’

এরপর অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করতে করতে তারা গাড়িতে গিয়ে উঠলো।

গাড়ি আবার দৌড়াতে থাকলো। আস্তে আস্তে সামনে এগিয়ে গতি বাড়াতে থাকলো। ধীরে ধীরে আওয়াজ ম্লান হয়ে গেলো। মৃদু বাতাস বইছে। থরথর করে কাঁপছে আলেয়া। অন্ধকার ঠেলে শরীরের সর্বশক্তি নিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। ভোরের আলো ধীরে ধীরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে।

ফোঁ ফোঁ ভেঁপু বাজিয়ে পূর্বদিক থেকে ছুটে আসছে মেঘনা ট্রেন। কোমরে হাত চেপে অনেক কষ্টে দাঁড়িয়ে উঠলো সে। ভেবে পাচ্ছে না, এখন তার কী করা উচি?

সামনে তার তিনটি পথ খোলা: প্রথমত-থানা, দ্বিতীয়ত-নিজের বাড়ি, তৃতীয়ত-রেলগাড়ির চাকা।

আলেয়া এখন কোন পথে হাঁটবে?

নাকি অন্য কোনো পথ তার জানা আছে?

 

আরো পড়ুন- আলাউদ্দিন আল আজাদের গল্প – জলটুঙি

error: Content is protected !!