এক পেয়ালা হাইকু নিয়ে দু’কলম- রুশিয়া জামান রত্না
গ্রন্থের নাম: এক পেয়ালা হাইকু
গ্রন্থের ধরণ: অণুকাব্য
কবি: টিটো মোস্তাফিজ
প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান: রচয়িতা
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারী ২০২৩
প্রচ্ছদ: টিটো মোস্তাফিজ
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৪৮
প্রচ্ছদ মূল্য: ২০০
ISBN: 978-984-95638-0-8
মানুষের প্রয়োজনেই সৃষ্টি হয়েছে সাহিত্যের। সময়ের পরিক্রমায় সাহিত্য নামক বৃক্ষে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন শাখা প্রশাখা। বাংলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন চর্যাপদ ছিল মূলত গানের সংকলন বা কাব্য সাহিত্য । তারপর কাব্য সাহিত্যের আরেক নিদর্শন পাওয়া যায় চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। কালের ধারাবাহিকতায় কাব্য সাহিত্যের অনেকগুলো রুপ প্রত্যক্ষ করা গেছে। তেমনই কাব্য সাহিত্যের নবীনতম রুপ হলো হাইকু।
হাইকু
হাইকু তিন লাইনের শিরোনামহীন কবিতা যা এক নিঃশ্বাসে পাঠ করা যায়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, সপ্তদশ শতকে জাপানে হাইকুর আবির্ভাব ঘটে মাৎসুয়ো বাসোর হাত ধরে। হাইকুতে সর্বোচ্চ ১৭ ধ্বনি থাকে। ১ম ও ৩য় লাইনে ৫টি করে মোট ১০টি এবং ২য় লাইনে ৭টি ধ্বনি ব্যবহৃত হয়। এর ভাষা হতে হবে সহজ সরল। এর প্রথম লাইন কিংবা তৃতীয় লাইনের সাথে অন্য দুই লাইনের সরাসরি কোন সম্পর্ক থাকবে না। দুই লাইন এবং এক লাইন — এই দুই অংশ মিলে তৈরি হয় একটি হাইকু। এই দুই অংশের সম্পর্ক-সূত্রটি বৈপরীত্য অথবা তুলনা বুঝায়। যেমন-
“এক জোড়া জুতা
রয়েছে পাশাপাশি-
শূন্যতা ভরা”
হাইকুকে যিনি অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন তিনি কোবায়াশি ইশা। ইশা তাঁর ছদ্মনাম। কোবায়াশি ইশা ছোটখাটো জীব, কীটপতঙ্গ, তুচ্ছ জিনিস, মানুষের সূক্ষ্ম অনুভূতি নিয়ে হাইকু রচনা করতেন তাঁর হাইকু জীবনের ছোটখাটো জিনিস উপভোগ করতে উৎসাহিত করে। যেমন-
“চায়ের পেয়ালা-
কলকাকলি বা ফুল
ভোলায় দুঃখ ব্যাথা”
বাংলা সাহিত্যে বিদেশি এই অণুকাব্যকে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে যে কয়েকজন কবি কাজ করে যাচ্ছেন তাদের মধ্যে অন্যতম টিটো মোস্তাফিজ। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা তিনটি যার মধ্যো দুটি কাব্য গ্রন্থই হাইকু নিয়ে লেখা।
কবি পরিচিতিঃ
১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া উপজেলার মাড়িয়া গ্রামে। রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ থেকে এসএসসি এবং এইচএসসি পাশ করে ভর্তি হোন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। বর্তমানে তিনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদপ্তরে উপপরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন। সরকারি দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি তিনি কাব্য চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। ক্যাডেট কলেজ ব্লগ এবং অলপোয়েট্রিতে নিয়মিত হাইকু, ছড়া, কবিতা, রুবাই, বিদেশি ভাষার অনুবাদ লিখে থাকেন।
টিটো মোস্তাফিজ জাইকা আয়োজিত যুব আমন্ত্রণ প্রশিক্ষণে জাপান সফর করেন। সেখান থেকেই কবিতার ক্ষুদ্রতম রুপ হাইকুর প্রতি আকৃষ্ট হোন। মাসাওকা শিকির হাইকু অনুবাদ করতে গিয়ে তার কবিতা লেখা শুরু। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষাতেই হাইকু লেখেন। দেশি বিদেশি নানা পত্রিকায় তার লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। তার প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ —
১) সালতামামির পঙক্তিমালা (২০১৯)
২) হাইকু অভিযাত্রা (২০২১)
৩) এক পেয়ালা হাইকু (২০২৩)
গ্রন্থের বিষয়বস্তু:
হাইকু নিয়ে লিখতে গিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাইকু নিয়ে লিখেছেন —
“হাইকু হলো হৃদয়ের কৃচ্ছতা”
অর্থাৎ, খুবই অল্প সময়ে হৃদয়ের গভীর অনূভুতির খোঁজ না করে ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়া শব্দমালার বহিঃপ্রকাশই হলো হাইকু।
বাংলা সাহিত্যে হাইকু নবীনতম শাখা। টিটো মোস্তাফিজ রচিত গ্রন্থ “এক পেয়ালা হাইকু”। ৪৮ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে মোট ১৭৬টি হাইকু রয়েছে। হাইকুগুলো কবির জীবনের প্রত্যক্ষ অনুভূতি, উপলব্ধি, দৃষ্টি গোচর হওয়া কোন বিষয়, ঋতু বৈচিত্র্য, দর্শন ইত্যাদি নিয়ে লিখেছেন। যেমন-
” ইস্কাপনের রাণী-
হীরে নাকি হৃদয় নেবে
কোনটা বেশি দামী”
হাইকু লিখেছেন বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ এর অভিজ্ঞতা ও নিদারুণ দুর্বিষহ জীবনের উপলব্ধি থেকে। সমাজের বৈষম্য তুলে এসেছে তার হাইকুতে। যেমন-
“মুড়ি আর পানি-
কাচ্চি বিরিয়ানির ঘ্রাণে
জল আসে চোখে”
অসহায় দরিদ্র মানুষের অসহায়ত্ব তাকে ভাবায়।
“জিলাপির লাইন-
গোপনে খুঁজে ফিরি
টিসিবির ট্রাক”
চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ তার কবি মনকে জাগিয়ে তোলে। যেমন-
“পাতাহীন শাখে
শিমুল ফোটার ধুম-
মৌমাছির গুঞ্জন”
আরেক জায়গায় তিনি লিখেছেন –
“কৃষ্ণকপক্ষের চাঁদ
বহে বাতায়ন পাশে-
বনলতা সেন”
মেকি প্রতিযোগিতা, মনুষ্যত্বের অবক্ষয়, নিরমমতাকে তিনি ব্যঙ্গ করেছেন হাইকু লেখার মাধ্যমে।
“কৃতজ্ঞতার মূল্যায়ন
আজ সেলফি উপচে পড়ে-
গর্ভধারিণী মা!”
হাইকুসমূহে বাংলা ঋতু বৈচিত্র্যের বিষয়ও এসেছে সচেতনভাবে। যেমন-
“বসন্ত বিলাপ-
ঠোঁট দুটো নিয়েছে লীজ
মাঘের কুয়াশা”
কবি টিটো মোস্তাফিজ বাংলা সাহিত্যে হাইকুর স্থায়ী অবস্থান তৈরিতে এবং সাধারণ পাঠকদের মাঝে হাইকুকে জনপ্রিয় করার জন্য নিয়মিত হাইকু লিখে যাচ্ছেন। “এক পেয়ালা হাইকু” গ্রন্থটি এরই প্রেক্ষিতে রচিত। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে মানুষের জীবনে ব্যস্ততা বেড়েছে তা সাহিত্যের উপভোগের সময় কমিয়ে দিয়েছে জ্যামিতিক হারে। এই সল্প সময়ের মাঝে “এক পেয়ালা হাইকু” গ্রন্থটির হাইকুগুলো ছোটো ছোটো সুখের অনুভূতি এনে দিতে পারে।
*রিভিউ লেখক: রুশিয়া জামান রত্না– সমাজসেবা অফিসার