একগুচ্ছ কবিতা- মাহফুজ সজল
সুসম্ভব নিত্যজন্মে…
প্রিয়তমা তুমি জেনো,
এইযে বিক্ষিপ্ত রাত্রির ক্ষান্ত জীবন ভ্রমণ:
উৎকণ্ঠায় আনন্দ খোঁজা নির্ঘুম জোড়;
কৌরালের কৌমার্যহীন রবাহুতি- সহসা
ভয়হীন পরিস্ফুট নিশিগন্ধ্যা; কোমল
জোছনা হয়ে রেশমের মতো অঙ্গে অঙ্গে
জড়ানো। অথবা, স্মৃতির ক্ষতচিহ্নে
জীবন্মুক্ত প্রলেপ- তারার চোখটি হয়ে
পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ানো; ছলোচ্ছল
গল্প শোনানো যদি ঘোড়াউত্রার তীরে ব্যর্থ
প্রেমাংশু মায়া! কিংবা, ঘুমের ভেতরে
শ্রমঘামের অধীরতা- হেলায় হেলায় স্পন্দিত
তবু টুকরোখানি সহাস্য জনম; প্রভাতী
মুখরতায় ব্যক্তিগত ভৈরবী রাগ; অলস
দুপুরের ঘষামাজা- কার যেন পোর্ট্রেট
আঁকা- তপ্ত রোদে কাগজ কালির
সঙ্গমস্থলে আকাঙ্ক্ষিত ছায়ানুসন্ধান;
দিগন্তের বেদনার্ত ধূসরীমায় খুঁজে ফেরা
মেঘমল্লার; ঝিলিমিলি সন্ধ্যার আবীরে
প্রবোধসম গেরুয়া অঙ্কন- সমুহ কার্যের
বাহ্য প্রয়াণ- ‘একটা আলো একটা অন্ধকার
কিংবা একেকটা আলো-আধারি’র সহজ
প্রণত কৃত্য বুনন’-
এ সবই আমার ক্রমশঃ নতুন জন্ম…
জেনে রাখো, এ জন্মের কোন কথিত
ঔরস নেই; আছে শুধু ঐতিহাসিক
সম্ভাবনার সুসম্ভব শিল্পজরায়ু;
-ওটা চেতনার ভাবোত্তল রক্ত প্রসবন।
..
এসো তোমার আমার শ্বাস মিলিয়ে দেখি
করে দেখি চুম্বনে বিবস হওয়ার প্রাথমিক
চেষ্টাটুকু। ভেঙে যদি দিতে পারি অনাগত
অন্ধকার, যদি খুঁজে পাই ঈপ্সিত বর্তমান!
(অবশ্য এরকমই হয়- পৃথিবীর তাবৎ
অন্ধকার একটু একটু করে ঘুচে যায়, যাবে।
সব প্রেমাহুত প্রত্যাশায় এমনই সার্বজনীনতা)
দেখবে উভয়ই প্রশ্বাস; স্বাভাবিক দুর্গন্ধে
পিছু হটবো তুমি, আমি। তবু, অকাট্য সত্য
কামনায় কেমন জড়িয়ে রবো তিলে তিলে!
…
অমুল্য অতি সৃষ্টির সৌকর্যে কী অবান্তর
অতি ধ্বংস প্রকরণে তাই আপ্লুত হই,
বিস্মিত হই; হেরে যাইনা তবু দমে যাইনা
প্রিয়তমা। ঝোঁকে থাকি ভেতরে ভেতরে
ভালোবেসে মহৎ পাষাণ; বিবরে বিবরে
তুলি আলো ঝংকার…! আমিতো হতে
চাই যুগপৎ আলোর মিছিল, তোমাকে ভালোবাসার সমান।
কবিতা
ভরে আনি স্মৃতি-করপুট
মালতী-প্রভাতবেলা,
আমি হই কমল গাঙে
অজানিতে ভাসানো মালা।
সুন্দরের সন্ধান লৈয়ে
প্রেমে ভরা হাটি যতদূর,
অনেক হারিয়ে দেখি
সে আমার স্বপ্ন মতিচুর!
সে আমার বোবাজন্মে
অতি অতি ঝর্ণামুখো কথা
সে হিয়ায় ডুকরে উঠা
অচিন বেদনার অনির্ণেয়তা!
প্রবোধ আস্বাদন
যার জন্য জেগে থাকো সে তো নাই, রাত্রি
ফুরায়া গেল সুন্দর কদর্যতায়, তবে যাক।
ঘুমাও ঘুমাও হে বিনিদ্রা; ডিএক্টিভ হও না কেন লাল
আর নীলে মেশা ও’তুমি বেগুনী কালার মহৎ।
এতো প্রয়োজন কীসে- কেন্
বিয়োগ ছড়ায়া দাও গীতল মগ্নতার চিরে।
অন্তরে সামুদ্রিকতা পেতে এমন রাজসিক
ফতুরতা লাগে- তুমি ভুলতে চেয়েছ পৃথিবীর
ছায়া কোন প্রিয় ট্রায়াঙ্গল দ্বিধা- অর্গানিক
লোহুমজ্জার। লাগেত, কাঠিন্য গমনে মানুষের
এমনকিছু সহাস্য মাতলামো লাগে। বিশ্বাসে
যদি হাসো তবে তুমিই কেরোসিন রঙের
চোলাই- সহযাত্রিক ঘুম ও প্রশান্তি চুম্বনের
পৃথ্বী- কোন আছোঁয়া সৃষ্টির শিল্পাচারী পেতে
পারো প্রবহ যৌবনের নাক্ষত্রিক অন্ধকার-
আরো অমূল্য করে একার একাধিকতা
হতে পারো; প্রবেশিত হতেই পারো কৌম
মাধবীপট- কোন শতদল স্বগতোক্তির গ্যঞ্জামে।
অর্থহীন কিছু নয়- যা দেখছো বলে স্থির-
তাঁর শতভাগ সত্য অস্থিরতায় আগামবিবৃত
হয়েছিল তোমারই মন অজানিতা। যাও,
যে অস্থিরতা পাশ কাটিয়ে স্থিরতার গ্রহণে ফিরেছে,
রজনীগন্ধা নিয়ে একদিন তাঁর
প্রত্যাখ্যাত হওয়া আগামী শীতের অনলে,
তুমি যবে অনসূয় হিজলের মালা হয়েছিলে
কোন একদিন।
মৌনতার আলোড়নে আসো হে মন
আপাতত নিঃসঙ্গতা বলে কিছু নেই। যেতে
হয় তাই ঘুরেফিরে আসে প্রাণের প্রাদক্ষিণতা।
শুভ বিদায় বলে কিছু নেই, না আছে
সু-স্বাগতমের মুখস্থ প্রণিপাত। নিজেকে
বল কোনো ঘ্রাণের সহমিলনে আধবার
সাধাণাচারীতায় পড়ে মানুষ; যে হাওয়ায়
প্রাণিত সে, একই হাওয়া দৃশ্যত স্থিতিগুলো
ছিন্নমূল বিপন্ন করতে ভুলে না। প্রবোধিত হও,
হতে পারো গঞ্জের খেদহীন কোন সারল্য
প্রবণ- প্রবঞ্চনাহীন এই মতে- মানুষ মানুষই-
এতো অভিনয় অভিজন যার খোদ ঈশ্বর
চর্চিত চিন্তারও খেয়ালে ছিল না!
আপাতত দুঃখ বলে কিছু নেইঃ একটা পথ
জুড়িয়ে নিতে আছে, থাকেত এমন কিছু
অশ্রুতন্তুর মালামুখী সুতোর প্রয়াস। ক্ষণকাল
ঘুমিয়ে পড়; নিমিলিতি বল ও’ দস্তখতহীন
সৃষ্টির আনমনা বিভা, যে যেতে চেয়েছে তাঁকে
ঘুরেফিরে আসবার শৃঙ্খলহীন সাকল্য দিতে
পারো; আপাতত নিঃসঙ্গতা বলে কিছু নেই,
প্রিয় মাতলামো তুমি কালিমাপ্রোজ্জ্বল হেসে
কবিতার দায় নিতে পারো।
কবি পরিচিতিঃ মাহফুজ সজল- কবিতাপ্রবণ ভাঙনের এক ‘কাইমেরবাউলি’ মেলা। জন্ম, বেড়ে উঠা কিশোরগঞ্জ এর বাজিতপুর- ‘ঘোড়াউত্রা’ নদীবর্তী ‘বলিয়ারদী’ গ্রামে। বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হতে শিক্ষাজীবন শেষ করে বর্তমানে একটি সেবামূলক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। অবসর পেলেই ঘুরতে বেড়িয়ে পড়েন বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চল- ভাটিবাংলার রূপ রহম পানে। কিছুকাল মঞ্চনাটকে যুক্ত ছিলেন; বাজিতপুর ‘পৌরাণিক থিয়েটার’ এর একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
আরও পড়ুন- জামিল হাদীর একগুচ্ছ কবিতা