Mostafizur Rahman is a professional content writer at CrawlText, specializing in SEO articles, blog posts, and web copy that drive engagement and conversions. With experience crafting clear, audience-focused content for almost all the niches, he delivers well-researched, optimized pieces on deadline. He combines editorial rigor with keyword strategy to boost traffic, authority, and reader retention across blogs, platforms, and newsletters.
লোকটার দিকে তাকিয়েই ঈর্ষায় বুকটা জ্বলে যায় সোবহান সাহেবের। অধ্যাপক আব্দুস সোবহান। জার্মানির নাম করা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি বোগলদাবা করে যখন দেশে ফিরেছিলেন, তখন দেশের প্রতি ছিল সীমাহীন ভালোবাসা আর দেশের মানুষের প্রতি ছিল অগাধ বিশ্বাস। ফানুস হয়ে সেসব বহু আগেই উড়ে গেছে হাওয়ায়, পুড়ে গেছে নিদারুণ সব অভিজ্ঞতার তাপে। তা যাক। এখন আর সেসব নিয়ে অনুযোগ নেই। অনুশোচনাও নেই। আছে অব্যক্ত হতাশা। আছে পারিপার্শ্বিকতার চাপে নিজের ভেতরে জন্ম নেয়া অস্ফুট হাহাকার, চাপা কষ্ট। সেগুলো বুকের নিভৃতে জমা রেখেই পথ চলেন অধ্যাপক সোবহান। পড়শীরা বলেন সোবহান সাহেব। পড়শী! শব্দটা মনে করে হা হা শব্দ তুলে খানিক হাসলেন তিনি। শেষে ফুঃ জাতীয় শব্দ করে পড়শী নামক অলীক শব্দটাকে সমূলে উড়িয়ে দিলেন হাওয়ায়। পড়শী মানে কী? দুঃখ-সুখে উড়ে এসে পাশে পড়ে যে? সান্ত্বনার বাণীতে, সহানুভূতির সাহচর্যে উজ্জিবিত করার চেষ্টা করে যে, যে দেয় নতুন করে বেঁচে ওঠার মন্ত্র? হু। সেই তো পড়শী! ঢাকা শহর নির্মম। নিষ্ঠুর। পরক্ষণেই মাথা ঝাঁকালেন সোবহান সাহেব। না। ভুল। ঢাকা শহর নয়। সময়টা নির্মম। আধুনিকতার খোলসে সভ্যতাকে গিলে খাচ্ছে যে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি, গড়ে উঠছে যে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা, সেটা নির্মম। মানুষকে করে তুলছে স্বার্থপর, বিচ্ছিন্ন। ঢাকা শহরে কেউ কারো পড়শী নেই আর এখন। আছে মুখচেনা কিছু আড়ষ্ট হাসি। দেখা হলে, ভালো? কিংবা মেকি হেসে পাশ কাটিয়ে যাওয়া, তারচেয়ে বেশি কিছু নয়। কখনো কখনো সেটুকুও বেশি মনে হয়। সবশেষ নিয়োগ দেয়া ড্রাইভার চুরি করে পালিয়েছে সপ্তাহখানেক হল। আপাতত কাউকে নিয়োগ দেয়া যাচ্ছে না বলেই রিকশায় যাওয়ার চেষ্টা। কিন্তু লোকটাকে দেখেই মেজাজ চরমে উঠে গেল সোবহান সাহেবের। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসাঁইটে অধ্যাপক তিনি। রক্তে মিশে গেছে লোকজনকে সহবত শেখানোর অভ্যাস। বেয়াদবি মোটেই বরদাশত করতে পারেন না তিনি। আর লোকটার বসার ( না কি শোয়ার?) কী ছিরি! হারামজাদা! সীটে হেলান দিয়ে চালকের আসনে দুই ঠ্যাং উঁচু করে তুলে আধশোয়া হয়ে ঝিমোচ্ছে। ঠ্যাঙের নিচের লুঙ্গি যে কোথায় নেমে হাওয়া খাচ্ছে, ব্যাটা উল্লুকটার সেদিকে নজরমাত্র নাই। লোকটাকে কষে একটা ধমক দিতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলেন সোবহান সাহেব। ভেতরে ভেতরে ঈর্ষায় জ্বলে গেলেন। অমন একটা সহজ, স্বাভাবিক, অনাড়ম্বর জীবন পেলে মন্দ হত না! আহা!
এই রিকশা, যাবে?
গম্ভীর, রাগী গলায় লোকটাকে প্রশ্নটা করলেন অগত্যা। ঘড়ি দেখলেন। সময় বেশি নাই। একটা টিভি চ্যানেলে টক শো-তে কথা বলার আমন্ত্রণ আছে তার। সেটা শেষ করেই ছুটতে হবে আরেকটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে। বিকেলে অন্য চ্যানেলে টক শো। নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস বড় একটা নেয়া হয়ে ওঠে না তার। সময় করে উঠতে পারেন না। তাছাড়া এত বেশি কোন্দল সেখানে, এত দলাদলি, দুমিনিটেই হাঁপিয়ে ওঠেন তিনি, দুদণ্ডেই কাহিল হয়ে যান। বড্ড পেরেশানি লাগে ওসবে।
লাল চোখ খুলে তাকাল লোকটা। বিরক্ত, নিরাসক্ত গলায় বলল, কই যাইবেন?
কারওয়ান বাজার। যাবে?
অইন্যদিক দেহেন। যামু না। -বলে প্রবল উপেক্ষায় সোবহান সাহেবকে অগ্রাহ্য করে সে আবার চোখ বন্ধ করে আগের মতই ঝিমুনিতে মন দিল। অপমানে লাল হয়ে উঠলেন সোবহান সাহেব। ইচ্ছে হল ঠাটিয়ে এক চড় লাগান হারামজাদাটার গালে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা তাকে যমের মত ভয় পায়। রাজনৈতিক মহলে তার প্রভাব কম নয়। মিডিয়াপাড়ায়ও যথেষ্ট দাপট তার। আর এই হারামজাদা আধন্যাংটা রিকশাঅলা কি না তাকে এমন তাচ্ছিল্যে উড়িয়ে দেয়! যেন তিনি ব্যাটার কাছে ভিক্ষে চেয়েছেন!
অতি কষ্টে নিজেকে দমন করলেন সোবহান সাহেব। নিজের অস্থির স্বভাবের জন্য লাইসেন্স থাকা সত্বেও ড্রাইভিংটা এড়িয়ে চলেন তিনি। কয়েকবার চেষ্টা যে করেননি তেমন নয়। চেষ্টার ফল ভালো হয়নি। অভিজ্ঞতার ঝুলি অতিশয় তিক্ত তার। নইলে এই ভরদুপুরে নিজের গাড়ি গ্যারেজে ফেলে রিকশা খুঁজতে যান তিনি! আর ড্রাইভার হারামজাদাটা এত অকৃজ্ঞত! মাসে বিশ হাজার টাকা বেতন, বছরে দুটো বোনাস, একটা ইনক্রিমেন্ট, সপ্তায় একদিন ছুটি, আর অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা তো ছিলই। বিপদে-আপদে কেঁদে পড়লে ছিল সাহায্যের নিশ্চয়তা। তবু এভাবে সোবহান সাহেবকে পথে বসিয়ে পালাল! ব্যাটা নেমকহারাম! বিড়বিড় করে কথাটা বলেই অন্য রিকশার খোঁজে তৎপর হলেন তিনি। এই শ্রেণির লোকগুলো এমন বদমাশ আর অকৃজ্ঞত বলেই মূলত ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না এদের’ মনে মনে সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন অতঃপর। দূর থেকে এগিয়ে আসা রিকশাটাকে ইশারায় ডেকে সেটা কাছাকাছি আসতেই অনুমতির তোয়াক্কা না করে লাফিয়ে উঠে বসলেন সিটে। হাতে ধরা সিগারেটে আয়েশ করে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন একমুখ। ঘূর্ণাকারে ছড়িয়ে গেল একরাশ ধোঁয়ার কুণ্ডলি। পাক খেতে খেতে মিশে গেল হাওয়ায়। সেদিকে তাকিয়ে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন সোবহান সাহেব। অকারণেই ফুসফুস থেকে একদঙ্গল কার্বন-ডাই-অক্সাইড উড়িয়ে দিলেন চারপাশে। তারপর গম্ভীর, নিচুগলায় আদেশ করলেন, কারওয়ান বাজার চল।
আরও পড়ুন- হাসান আজিজুল হকের গল্প: সরল হিংসা
কথা না বাড়িয়ে প্যাডেল ঘোরাল লোকটা। অন্যমনে শহরের জনাকীর্ণ শরীরের দিকে তাকিয়ে ক্ষণকাল আগে দেখা রিকশাঅলার কথা ভাবতে থাকলেন সোবহান সাহেব। লোকটা স্বাধীন। কাউকে তোয়াক্কা করার প্রয়োজন নাই তার। কাউকে তেল দেয়ার বাহুল্য কসরত নাই। ইচ্ছে হলে রিকশা চালাবে, না হলে পুরো পৃথিবীকে অগ্রাহ্য করে সে নিজের রিকশার সিটে আধশোয়া আর ন্যাংটাপ্রায় হয়ে ঝিমোবে। তাতে কার বাপের কী! অথচ তিনি নিজে! বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসাঁইটে অধ্যাপক, দেশে-বিদেশে একনামে চেনে সবাই, তবু জীবনের প্রতি পরতে পরতে কত যে দাসত্বের গিঁট, বশানুবদতার কত যে বমনোদ্রেককারী মলিন ইতিহাস! এরচেয়ে বরং ওই সরল জীবন ভালো! ভালো ওই দৈন্যভরা সহজ যাপন! সাবধানে রিকশা থেকে নামলেন সোবহান সাহেব। ভাড়া মিটিয়ে এগিয়ে গেলেন লিফটের দিকে। মাথা থেকে রিকশাঅলার ভাবনাটাকে তাড়ান যাচ্ছে না কিছুতেই। লোকটা যেন ঈর্ষায় পুড়িয়ে দেবে তাকে। আশ্চর্য!
কাল রাতে কিছুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি তিনি। মাঝে মাঝে হয় অমন। এই বয়সে এসে কী যেন গণ্ডগোল ঘটে যায় নিজের ভেতরে, কেমন ওলোটপালোট লাগে, বোধের পারদ কেমন থির হয়ে আসে হঠাৎ হঠাৎ।
কালও তেমন। নিজের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শেষে ফোন দিয়েছিলেন রাকাকে।
তিথিকে সচরাচর আর ফোন করেন না তিনি আজকাল। দাম্পত্য সম্পর্ককে অগ্রাহ্য করার মন্ত্র যদিও-বা আয়ত্ব করেছেন তিনি প্রায় অনায়াসেই,কিন্তু সন্তান বাৎসল্য নিয়ন্ত্রণ করার তরিকা আবিষ্কার করতে পারেননি এখন পর্যন্ত। তাই রাকাকে ফোন না দিয়ে তিনি থাকতে পারেন না একদম। রাকা বিরক্ত হয়। রাকা মাত্রাতিরিক্ত রিএক্ট করে। বুকের ভেতর তখন কী যেন একটা হিংস্র প্রাণী ভীষণ জোরে খামচি দিতে চায়। প্রচণ্ড জোরে লাঙল চালাতে চায় হৃৎপিণ্ডের কোমল ভিটেয়। উলটেপালটে দিতে চায় চেনা পৃথিবীটা। কালও তেমনই হল। রাকাকে ফোন দিতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল সে। অনেকবার রিং হওয়ার পর তবে ফোন ধরে রাকা। কখনো-বা ধরেই না। কালও অনেকবার ফোন বাজার পর তবে ধরল। সোবহান সাহেব হতাশ, হতোদ্যম হয়ে যখন ফোন রেখে দেবেন ভাবছিলেন, ঠিক তখন ফোন ধরল রাকা।
হেই ড্যাডি? হোয়াটস রং উইদ য়্যু?
নাথিং ডিয়ার। হাউ আর য়্যু, মাই সুইট মম?
আই আ্যাম কোয়াইট ওকে ডিয়ার। বাট হোয়াই আর য়্যু সো ক্রেজি ড্যাডি? আই অ্যাম ভেরি বিজি, য়্যু নো…
ইয়েস মাই ডল! আই নো! ইউ আর অলয়েজ বিজি!
ওহ ড্যাডি! কাম অন! ইটস নট ইউর পুউর বাংলাডেশ! লাইফ ইজ সো ফাস্ট হিয়ার! এন্ড সো ক্রাউডি!
ইয়েস মম! ইয়েস! বাট নাউ আ ডেইজ আই ডোন্ট ফিল সো ওয়েল মাই গার্ল। আই ফিল ব্যাড ফর সাম ডেইজ। আই থিংক আই হ্যাড সাম ট্রাবল ইন মাই হার্ট!
ওহ ড্যাডি! দেন হোয়াই হ্যাভ য়্যু বদার উইদ মি? অ্যাম আই আ ডক্টর? আই’ম নট, য়্যু নো! ইউ স্যুড গো টু আ ডক্টর ইমিডিয়েটলি। প্লিজ ড্যাডি, ডু কন্টাক উইদ আ ডক্টর অ্যান্ড মেক আ সিটিং ইউদ হিম। ডোন্ট মেক মোর ডিস্টার্বেন্স টু মি নাউ, প্লিজ!
ফোনটা ভীষণ নীরব হয়ে গেছিল এরপর। ভীষণ নিথর। সোবহান সাহেবও। জীবনটা কবে, কখন আর কীভাবে যে এতটা কাঙাল করে দিল তাকে, করে দিল এমন ছিবড়ে, ভেবে থৈ পান না তিনি আজকাল। টক শো তে বসে গুরুগম্ভীর আলাপ আর ভারী কথার তর্ক-বিতর্কের ফাঁকফোকর গলে রাকার কথাগুলো তাকে আনমনা করে দেয়, নিজের অজান্তেই কোথা থেকে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। টক শো-তে বরাবর চৌকস তিনি, বিরোধী বক্তাকে তীক্ষ্ণ যুক্তি আর কথার মারপ্যাচে কাবু করে ফেলেন অতি সহজেই। অতি অল্পেই ধরাশায়ী হয়ে লেজেগোবরে অবস্থা হয় তাদের। কোনো টক শো-তে তিনি থাকা মানেই দর্শক টেনে রাখা, টানটান উত্তেজনায় টিভি রিমোট সেই চ্যানেলেই স্থির থাকা। কিন্তু আজ কিছুতেই মনোযোগটা রাখতে পারেন না সোবহান সাহেব। খেই হারিয়ে ফেলেন বারবার। উপস্থাপক ছেলেটা খানিকটা অবাক হয়। জলের গ্লাসটা এগিয়ে দেয়, নিচুস্বরে একবার জিগ্যেসও করে নেয় তিনি ঠিক আছেন কি না। ঢকঢক করে জল খান সোবহান সাহেব। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে খানিকটা ফিকে হাসেন। মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করেন আলোচনায়। যেন-তেন প্রকারে আলোচনাটা শেষ করে তিনি বেরিয়ে পড়েন আবার। উবার ডেকে রওনা দেন পরবর্তী গন্তব্যে। লাঞ্চ করা হয়নি এখনো। খিদেও পেয়েছে বেশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিন থেকে করা যাবে, ভেবেই খিদেটাকে আপাতত ঝেঁটিয়ে বিদেয় করেন ভাবনা থেকে। কিন্তু ভাবনায় তিথি ফিরে আসে। তিথি। রান্নাটা বড় ভালো করত মেয়েটা। খেয়ে সুখ হত খুব। তিথি কি এখনো রান্না করে? ছোটমাছের চচ্চড়ি? কচু দিয়ে ইলিশের ঝোল? আহা। কত বছর খাওয়া হয় না তিথির হাতের রান্না! এ জন্মে কি আর খাওয়া হবে? না। সম্ভাবনা শূন্য। জীবন তাকে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে মস্ত এক শূন্যের সামনে। অনন্ত শূন্যতা তাকে গ্রাস করছে প্রতিদিন, একটু একটু করে। তিনিও পা বাড়াচ্ছেন সেই অতল শূন্যতার গহ্বরে, জ্ঞাতসারেই।
এই বয়সে এসে তিথির জন্য বুকের ভেতর আলাদা কোনো অনুভূতি টের পান না সোবহান সাহেব। বরং তিথিকে মনে পড়লেই কেমন এক শূন্যতা ঘিরে ধরে তাকে। কী যেন একটা হাহাকার বাজে হৃৎপিণ্ডের গোপন কুঠুরিতে। তাকে নিয়ে একসময় কত উচ্ছ্বাসই না ছিল তিথির! ছিল কত অপার্থিব অনুভব! তিনি নন, তিথিই প্রেমে পড়েছিল তার, নতজানু হয়েছিল প্রেমে। তখনও মা-ই ছিলেন একমাত্র বন্ধু ছেলের। মা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসাঁইটে অধ্যাপক, সোবহান সাহেবের একমাত্র আশ্রয়স্থল। বাবা ব্যবসার কাজে বেশিরভাগ সময়ই থাকতেন দেশের বাইরে। একমাত্র সন্তান হিসেবে সোবহান সাহেব ছিলেন মা-বাবার যক্ষের ধন। বাবার ব্যস্ততা আর অমনোযোগ মা পুষিয়ে দিতেন ছেলের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগে। ফলে কোনো নারী তখনও সোবহান সাহেবকে দখল করার সুযোগ পায়নি। কিন্তু তিথি পেল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরপরই কোত্থেকে উড়ে এসে সোবহান সাহেবের মনের মধ্যে জুড়ে বসল তিথি। মা-কে তিথির কথা জানাতেই পইপই করে নিষেধ করলেন তিনি। তিথির নাড়ি-নক্ষত্রের খোঁজ নিলেন দুদিনের মধ্যে। বললেন, হাভাতে ঘরের মেয়ে, এ কোনোমতেই তোর যোগ্য নয়, সোনা। তাছাড়া সমবয়সী প্রেমের ফল ভালো হয় না। এ মেয়েকে একদম পাত্তা দিস না বাবা, এ মেয়ে তোর ভবিষ্যতের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে নইলে।
সোবহান সাহেবের কাছে মায়ের কথাই বেদবাক্য তখনও। প্রথম দিকে তিথিকে তিনি এড়িয়ে গেলেন অনায়াসেই। কিন্তু তিথি নাছোড়বান্দা। তার প্রেম, তার নিঃশর্ত নিবেদন, সোবহান সাহেবের প্রতি তার অকৃত্রিম অনুভব, ধীরে ধীরে দূর্বল করে তুলল তাকেও। মায়ের বেদবাক্য নস্যি হল কোন অসতর্ক ক্ষণে, কোন অসচেতন মুহূর্তে সেখানে তিথির আওড়ানো প্রেমকাব্য অমিয় বাণী হয়ে বেজে উঠল রিনিঝিনি, বুঝতেই পারলেন না বেচারা সোবহান সাহেব। তার অধ্যাপক মা কম কথার মানুষ ছিলেন। ছেলেকে বাধা দেয়ার চেষ্টাটা জলে গেছিল যখন, বাধ্য হয়েই তখন মেনে নিয়েছিলেন তিথিকে। ব্যবসায়ি বাবাও একমাত্র ছেলের পছন্দের তারিফ করতে না পারলেও নীরব ছিলেন। বিশেষ উচ্চবাচ্য করেননি। মা শুধু বলেছিলেন, ভুল করলি বাছা। সারাজীবন পস্তাতে হবে। মিলিয়ে নিস আমার কথা।
মা-বাবা কেউ নেই আজ। কিন্তু মার প্রত্যেকটি কথাই সত্যি হয়েছে। বেঁচে থাকতেই তার আলামত দেখে গেছেন তারা দুজনেই। একমাত্র ছেলের অতৃপ্ত, অসুখি মুখের দিকে তাকিয়ে, নিজেদের বহু শ্রম আর ঘামে গড়া সম্পদের হরিলুট দেখে অপরিসিম মানসিক কষ্ট নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন তারা। সেসব মনে পড়লেই প্রবল অপরাধবোধে আক্রান্ত হন সোবহান সাহেব। তিথির সাথে জীবন জড়ানোর সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল। বিয়ের অল্প কিছুদিন পরেই সেটা বুঝেছিলেন তিনি, প্রতিদিন বুঝেছেন হাড়ে হাড়ে। কিন্তু করার ছিল না কিছুই। ততদিনে তিথি তার সন্তানের মা হয়ে গেছে। রাকার মিষ্টি, পবিত্র, তুলতুলে মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি বিকল্প কিছু ভাবতে পারেননি আর। তাছাড়া তিথির প্রতি দূর্বলতাও ছিল। তাকে ছাড়া তখনও নিজেকে ভাবতেই পারতেন না সোবহান সাহেব। কেন যে পারতেন না! এখন প্রবল অনুতাপ এসে চেপে ধরে তাকে। দম বন্ধ করে দিতে চায়। একটা জীবন অপচয়ে গেল। মা-বাবার একমাত্র সন্তান হয়েও তাদের তীব্র মনোকষ্টের কারণ ছিলেন তিনি, কোনোদিন তা মোচন করতে পারেননি। কোনোদিন পারেননি তাদের প্রতি তিথির ছুড়ে দেয়া অপমানের সমুচিত জবাব দিতে। তাদের জন্য আদতে কিছুই করতে পারেননি তিনি। বরং অসুখি করেছেন তাদের দিনের পর দিন, অতৃপ্তির চোরাবালিতে নিজেকেও ডুবিয়ে দিয়েছেন ক্রমেই। তিথি রাকাকে নিয়ে স্থায়ীভাবে পাড়ি জমিয়েছে ইউরোপে। সোবহান সাহেবকে প্রায় সর্বস্বান্ত করে দিয়ে সে থেকে গেছে সেখানে। রাকাও এখন অভ্যস্থ হয়ে গেছে ইউরোপের ব্যস্ততম জীবনে। সে আর বাবাকে চায় না এখন। বাবাকে তার প্রয়োজন নেই আর। যেমন তিথিও ছুড়ে ফেলেছে তাকে পরিত্যক্ত হিসেবে। অচ্ছুত বর্জ্যের মতো ত্যাগ করেছে তুমুল তাচ্ছিল্যে। তিথির কাছে তিনি ছিলেন ওপরে ওঠার সিঁড়ি, বৈতরণী পেরোনোর সাঁকো। তার প্রাচুর্যের ওপর দিয়ে তরতর করে ধাপগুলো অতিক্রম করে গেছে তিথি, ভালোবাসায় বিছিয়ে রাখা বুকের ওপর দিয়ে পেরিয়ে গেছে ইউরোপের নাগরিকত্ব পাওয়ার কঠিন বৈতরণী। মা-মেয়ে ইউরোপের ব্যস্ত জীবনে ডুবে গেছে। অথচ সোবহান সাহেব সেখান থেকে পালিয়ে বেঁচেছেন প্রায়। ওখানকার মেকি সভ্যতা আর অন্তসারশূন্য, অর্থহীন ব্যস্ততায় কিছুতেই খাপ খাওয়াতে পারেননি নিজেকে। তিথি আর রাকার চোখে ব্যাকডেটেড আর গাঁইয়া সোবহান সাহেব বাংলাদেশের মানুষের ঘামে আর জ্যামে ভরা, ধূলো আর ধোঁয়ায় ভরা এই শহরের চেনা অসভ্যতায় ফিরে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। কিন্তু সত্যিই কি বেঁচেছেন? একান্ত নির্জনতায়, নিভৃত নিরালায় প্রশ্নটা নিজেই তিনি নিজেকে করেন আজকাল। আর তখনই প্রবল হতাশা তাকে ঘিরে ধরে। পারেননি। নিজেকে তিনি সময়ের সাথে খাপ খাওয়াতে পারেননি। তাল মিলিয়ে চলতে পারেননি সময়ের দ্রুতলয়ে ফেলা ধ্রুপদী মুদ্রার সাথে। মা-বাবার সনাতনী জীবনের ঢিমেতালে যেমন অভ্যস্ত হতে পারেননি তিনি, তেমনি পারেননি তিথি আর রাকার অতি আধুনিকতার সাথে সহজ হতে। নিজের এই অক্ষমতা তাকে হতাশায় ডুবিয়ে দিয়েছে প্রায়। নিজেকে তার আপাদমস্তক এক ব্যর্থ, অসফল মানুষ মনে হয় ইদানীং।
আশলে আমি এক মস্ত উঁইঢিবি। বাইরে থেকে অভিজাত, সুখি আর সফল একজন মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝানু অধ্যাপক, তুখোড় তার্কিক, নামকরা প্রাবন্ধিক। কিন্তু ভেতরটা অন্তসারশূন্য। ফাঁপা।
কথাগুলো তিনি নিজেই নিজেকে আজকাল শোনান একান্তে।
পনেরোতলা বিল্ডিংয়ের সামনে রিকশা থেকে নেমে ধীরে সামনে এগোন সোবহান সাহেব। হাতে ব্যাগভর্তি বাজার। তার এপার্টমেন্ট বারোতলায়। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে। শরীর ভারী লাগে খুব। লিফটের দিকে এগোতে থাকেন অভ্যাসবশে। গার্ড দৌড়ে আসে। লম্বা সালাম দিয়ে হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে লিফটে তুলে দেয়। লক খুলে ভেতরে ঢুকেই এসি ছেড়ে দেন সোবহান সাহেব। গরম লাগে খুব। রিকশাঅলা লোকটাকে আবার মনে পড়ে। লোকটার বসার ভঙ্গি, সোবহান সাহেবকে অগ্রাহ্য করার কায়দাটা মনে পড়ে। মনে পড়ে হাসি পায় হঠাৎ। পাগলের মতো হাসেন তিনি গলা ছেড়ে। একলা থাকার এই এক সুখ। স্বাধীন তিনি। যা খুশি করতে পারেন। ইচ্ছে হলেই গলা ছেড়ে হাসতে পারেন। ইচ্ছে হলেই কাঁদতেও। ঠিক ওই রিকশাঅলা লোকটার মতো। পরক্ষণেই মনে হয়, না। ভাবনাটা ভুল। তিনি স্বাধীন নন। কিন্তু ওই লোকটা স্বাধীন। যে মেকি সভ্যতার হাত থেকে পালাতে রাকা আর তিথিকে ফেলে এখানে ফিরে এসেছিলেন তিনি, তার ভূত তাকে তাড়া করে ফিরছে প্রতিনিয়ত, করে রাখছে দাসানূদাস। নইলে কিসের মোহে এই অনন্ত অর্থহীন ছোটাছুটি তার! কিসের প্রত্যাশায় এত অহেতুক ব্যস্ততা! কী যে প্রচণ্ড ইচ্ছে করে তার নীরবতার হাতে হাত রেখে নিজের সাথে দুদণ্ড সময় কাটাতে! কী যে ভীষণ ইচ্ছে করে চুপচাপ কথা না বলে খানিকটা সময় পার করতে! তবু হয় কি! হয় না। সেই ক্লাসে গিয়ে বকরবকর, টক শোতে গিয়ে কথার তুবড়ি ছোটানো, পড়াশোনা, লেখালেখি! কলিগদের সাথে প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়, ক্যাম্পাসের নোংরা রাজনীতিতে মন না চাইলেও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যাওয়া! সবমিলিয়ে দম ফেলার ফুরসৎ মেলে না আর। তারচে’ খেটে খাওয়া ভীষণ সাধারণ ওই লোকটার জীবন সুন্দর। স্বাধীন। ইচ্ছে হলেই অবসর তার। ইচ্ছে হলেই দৌড়। আহা। আক্ষেপে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন সোবহান সাহেব। সিগারেটের ধোঁয়ায় ভরা ঘরে সে দীর্ঘশ্বাস হাওয়ার ঘূর্ণি তুলে ছড়িয়ে যায় লহমায়।
রিকশাঅলা লোকটা কিছুতেই ভাবনা থেকে সরে না। মাথার ভেতর লোকটার স্মৃতি আমূল গেঁথে যায়। লোকটা সোবহান সাহেবের সাথে উদ্ধতভাবে কথা বলে যায়, ব্যঙ্গ করে, ভেংচি কাটে। দিনশেষে লোকটা যেন আয়না হয়ে হাজির হয় সোবহান সাহেবের কাছে, যে তার জীর্ণতা, দারিদ্র্য আর ব্যর্থতার উল্টোপিঠে সোবহান সাহেবকে দাঁড় করিয়ে দেয়, আর সোবহান সাহেব ভারি বিপন্নবোধ করেন তাতে, নিজেকে তার নগ্ন মনে হয়, ন্যাংটা। দারিদ্র্যকে তখন তার মহান মনে হয়। মনে হয় সুখের আকর। যদি অমন একটা জীবন পাওয়া যেত! আহ! ফিসফিসে আফসোসবাক্যে ঘর ভরিয়ে তোলেন তিনি। অস্থির লাগে। অশান্ত। বুকের ভেতরটা চাপ চাপ লাগে হঠাৎ। বেসিনে গিয়ে হড়হড় বমি করেন তিনি। হঠাৎ মাধ্যাকর্ষণ বল প্রবলভাবে তাকে নিচের দিকে টানে। সে বলের অমোঘ নিয়মে মেঝেয় পড়তে পড়তে হঠাৎ শিশুবেলাটা চোখের সামনে ভাসে। ওই তো, মা তাকে কোলে নিয়ে ঘুরছেন সারাবাড়ি, ছড়া কাটছেন। পরক্ষণেই মনে হয়, তিথি। ভালোবেসে তাকে জড়িয়ে ধরছেন আশ্লেষে। আ রে দূর! ও তো রাকা! পাপা! পাপা! বলে আছড়ে পড়ছে সোবহান সাহেবের বুকে।
আরও পড়ুন- শিল্পী নাজনীনের গল্প: স্মৃতিভ্রষ্ট পরিব্রাজক

Mostafizur Rahman is a professional content writer at CrawlText, specializing in SEO articles, blog posts, and web copy that drive engagement and conversions. With experience crafting clear, audience-focused content for almost all the niches, he delivers well-researched, optimized pieces on deadline. He combines editorial rigor with keyword strategy to boost traffic, authority, and reader retention across blogs, platforms, and newsletters.
